ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি ভয়াবহ বর্বরতা
মুক্তির পথ কী?

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি ভয়াবহ বর্বরতা
মুক্তির পথ কী?
আন্দোলন প্রতিবেদন
বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ | অনলাইন সংস্করণ
দখলদার ইসরায়েল ৭ অক্টোবর ইসলামী ধর্মবাদী হামাসের একটি সামরিক হামলার অজুহাতে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের উপর এক ধারাবাহিক বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের গোলার আঘাত থেকে বাদ পড়ছে না হাসপাতাল, স্কুল, এ্যাম্বুলেন্স, মসজিদ-গীর্জা, আশ্রয় শিবির, শরণার্থী শিবির, অবকাঠামোসহ সকল স্থাপনা। ২৩ লাখ অধিবাসীর ১৪১ বর্গমাইল গাজা উপত্যকাকে এই বর্বর ফ্যাসিস্টরা এক ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫,০০০ নিহত ফিলিস্তিনির মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই নারী ও শিশু। আহত ৩০,০০০’র মধ্যেও ৭৫ শতাংশ নারী-শিশু। নিখোঁজ প্রায় ৬,০০০। নিহতের তালিকায় আছেন জাতিসংঘ কর্মী, সাংবাদিক, ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীও। আইসিইউয়ে থাকা রোগী, ইনকিউবেটরে থাকা শিশুরা, অপারেশনের রোগীরা হাসপাতালে জ্বালানি বা বিদ্যুতের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এসময়ে বাইরে থেকে আসতে দেয়া হয়নি খাদ্য, ওষুধ, তেল-জ্বালানিসহ নিত্য ব্যবহার্য কোনো কিছুই। নেই বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট। সুপেয় পানির উৎসগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ৭৫ শতাংশ ভবন ধ্বংসস্তুপে পরিণত।
সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ
বিশ্বের দেশে দেশে বিবেকবান, প্রগতিশীল/মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক শক্তি এবং জনগণ ইসরায়েলী সন্ত্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এবং ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতি সংহতি-সহমর্মীতা-স্বাধীনতার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাচ্ছেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ছাড়াও রোম, ডেনমার্কের ব্রাব্র্যান্ড, জার্মানির বার্লিন, অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা, নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারসহ বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিনের পতাকা উড়িয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান দেন।
এমনকি সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছে নেতানিয়াহু সরকার যুদ্ধাপরাধ করছে। তার ভাষ্যে– “গাজা শিশুদের জন্য কবরস্থান”। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক একজন কর্মকর্তা গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। তিনি বলেছেন– “যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ ইউরোপের বেশিরভাগ সরকার এ নৃশংস হামলায় জড়িত”।
ফিলিস্তিনে বর্বরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রণালয়ের কর্তা-ব্যক্তিরা পর্যন্ত অনেকেই প্রতিবাদ ও পদত্যাগ করছে। অনেক দেশই গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন, কেউ রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে। এমনকি আমেরিকা-ইউরোপ-বিশ্বের অনেক ইহুদি ব্যক্তি-সংগঠন জায়নবাদী নেতানিয়াহু সরকারের বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
ফিলিস্তিনের প্রত্যক্ষ শত্রু ইসরায়েল ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ
মার্কিনের প্রত্যক্ষ মদদে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি আগ্রাসনে পড়ে। ইসরায়েল অব্যাহতভাবে হত্যা-নির্যাতন ও বাস্তুচ্যূত করে। মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি জায়নবাদীদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যাদের এ অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ইসরায়েলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ষড়যন্ত্র। নিজভূমেই ফিলিস্তিনিরা পরবাসী। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিরা-তো বটেই, বিগত দিনে আরব বিশ্বের কোনো কোনো দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামরিকসহ সার্বিক সহায়তায় ইসরায়েলের কাছে আরবরা প্রতিবারই হেরে গেছে। সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে ধামাচাপা দিয়ে যুদ্ধরত দেশগুলোর মাঝে মিটমাট করেছে মাত্র। আপসবাদী মাহমুদ আব্বাসকে পশ্চিম তীরের আধিকারিক করে ইসরায়েল তার সম্প্রসারণবাদী নীতি ক্রমেই জোরদার করছে। অন্যদিকে গাজাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনকে বানিয়ে তুলেছে উন্মুক্ত কারাগার। সত্যিকার প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিকরা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে ক্রমেই দূর্বল হয়ে পড়ায় তার জায়গায় ইসলামী মৌলবাদী হামাসের উত্থান ঘটেছে। ধর্মবাদী ইহুদি জায়নবাদী ও হামাস ইহুদি-মুসলিমদের মধ্যে চরম সাম্প্রদায়িক বিভক্তির দেয়াল তুলে দিয়েছে। আর এতে মূল মদদদাতা হিসেবে ভূমিকা রাখছে সাম্রাজ্যবাদীরা।
সাম্রাজ্যবাদ ও আরব বিশ্বের ভূমিকা
ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের আগ্রাসী যুদ্ধ প্রায় দুই মাস অতিক্রম করছে। জাতিসংঘ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। মার্কিন সমর্থন ছাড়া জাতিসংঘ যে ঠুঁটো জগন্নাথ– এ পরিস্থিতি তারই প্রকাশ। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনের পোষা কুকুর ইসরায়েলের এ হেন পাশবিক কাজে সাহায্য-মদদ দিয়ে চলেছে মার্কিনসহ পশ্চিমা মিত্ররা। বিপরীতে চীন-রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদীরা ইসরায়েলি বর্বরতা বন্ধের দাবির আড়ালে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্য জোরদারের পাঁয়তারায় ব্যস্ত।
অন্যদিকে আরব বিশ্ব তাদের নিন্দা-মন্দ বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ আরব বিশ্বের ভূমিকা অনেকটা এরকম। মুসলিমসহ বিশ্বের জনগণের বিক্ষুব্ধ মনোভাবের নিরসনে জর্ডান-বাহরাইন-তুরস্ক রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করলেও নেই ওআইসিসহ অন্য আরব দেশগুলোর কঠোর কোনো পদক্ষেপ। লাশের সারি, ধ্বংসস্তুপের তলা থেকে আহতদের গগন বিদারী আর্তনাদ, ভেঙে পড়া চিকিৎসা ব্যবস্থায় আহতদের কাতরানি, ক্ষুধা-পিপাসায় ক্লান্ত গাজার অধিবাসীদের আহাজারি স্বত্ত্বেও তথাকথিত মুসলিম উম্মাহ ধর্না দিচ্ছে চীন-রাশিয়ার কাছে। ইরান কিছুটা উচ্চবাচ্য করলেও তা তাদের সীমার মধ্যে থেকেই। পশ্চিমাদের সন্তুষ্ট রাখতে আরব দেশগুলোর এ হেন নির্লজ্জ-পশ্চিমা তোষণ নীতিই আরব শেখদের বিলাস-ব্যসন-ব্যাভিচারের সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি। মূলত মধ্যপ্রাচ্যে আরব দেশগুলোতে বহাল স্বৈরতন্ত্র-সামরিক শাসন-রাজতন্ত্রের পেছনে আছে পশ্চিমাদের আশীর্বাদ। ফলে আরব রাষ্ট্রগুলো এখন ফিলিস্তিনের স্বার্থ দেখে মার্কিনি চোখে। গাজায় সংঘটিত এবারকার গণহত্যার পূর্বেও প্রায় হাফ ডজন আরব রাষ্ট্রের সাথে ছিল ইসরায়েলের কূটনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক। সৌদি আরবের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আলাপ এ যুদ্ধের কারণে ভেস্তে গেছে। এদের হাত-পা সাম্রাজ্যবাীদদের কাছে বাঁধা। ইসরায়েলের প্রতি আরব বিশ্বের মৃদু সমালোচনা মূলত আরব-মুসলিমসহ বিশ্বজনমতকে ভাওতা দেয়া বৈ অন্য কিছু নয়। আরব বিশ্বের অনুনয়-আবেদন-নিবেদনকে ইসরায়েল ও তার প্রভুরা থোড়াই কেয়ার করে।
হাসিনা, লীগ ও শাসকশ্রেণির ভূমিকা
‘কওমী জননী’ প্রধানমন্ত্রী তার বাকপটুত্তে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিন্দা ও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তার দেখানো পথেই তার মন্ত্রী-এমপি-দলীয় বেনিফিশিয়ারীরা ফিলিস্তিনিদের জন্য মায়া কান্না কেঁদে চলেছে। তারা ফিলিস্তিনের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে দেশীয়-আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের বিরোধীদের কোণঠাসা করার জায়গা থেকে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সেন্টিমেন্টকে তার ফ্যাসিবাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে এ প্রশ্নে হাসিনা সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও বিএনপি’র মৃদু সমালোচনা করছে।
কিন্তু তারা দখলদার ইসরায়েল রাষ্ট্র ধ্বংসের কোনো কথা বলছে না। স্পষ্টভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা ও বিরোধিতা করছে না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের হাত গুটানোর কথা বলছে না। সর্বোপরি মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি নির্বিশেষে সকল ধর্মের জনগণের ঐক্যের কথা বলছে না, একটি ধর্মনিরপেক্ষ অখণ্ড ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার কথাও বলছে না।
ইসরায়েল প্রশ্নে হাসিনা সরকারের দ্বিচারিতার এক বড় নমুনা এদেশীয় পাসপোর্টে ইসরায়েল ভ্রমণে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা উঠিয়ে দেয়া। হাসিনা সরকারের পরম মিত্র ভারত-মোদি ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ দোহাই তুলে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দনীয় ভূমিকা ও বিএনপি’র নীরবতাকে মৃদু সমালোচনা করলেও ভারত প্রশ্নে একেবারে চুপ। দেশে দেশে ইসরায়েলি যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ‘শান্তি সমাবেশ’র নামে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশকারী আওয়ামীলীগ ফিলিস্তিন ইস্যুতে পাঁচ জন লোককেও সমাবেশিত করেনি।
বিরোধী দল বিএনপিও তার নির্বাচনি বৈতরণী পার পাবার স্বার্থে ফিলিস্তিন প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটে আছে প্রভু মার্কিনিদের রুষ্ট হবার ভয়ে।
ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির পথ কী?
সাম্রাজ্যবাদীরা ধর্মের ভিত্তিতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন– এই দুই পৃথক রাষ্ট্রের যে ছবক দিচ্ছে তা হলো প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী কর্মসূচি। এটা হলো ইসরায়েলের দখলদারত্বের স্বীকৃতি ও বৈধতাদান। যদিও এটুকু ছাড় দিতেও ইসরায়েল আন্তরিক নয়।
ফিলিস্তিনি-ইহুদি জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্বিরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী সমাধানকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ-মুক্ত, স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ, অখণ্ড ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কর্মসূচিকে সামনে রেখে সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের ভিত্তিতে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বেই কেবল মাত্র সম্ভব।
ইসরায়েলি মন্ত্রীদের বক্তব্য
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু– “ফিলিস্তিনিরা মানব পশু” (HUMAN ANIMAL) ।
প্রেসিডেন্ট জ্যাক হারজোগ– “গাজার বাসিন্দারা নিষ্পাপ বেসামরিক নাগরিক নন, পুরো জাতিই দায়ী”।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী– “আমরা নরপশুদের সঙ্গে লড়ছি, গাজায় যে গণমৃত্যু শুরু হয়েছে, সেটা কেবল শুরু”।
– “এই যুদ্ধ শুধু হামাসের সঙ্গে নয়, ফিলিস্তিনি সব বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”।
নাৎসীপন্থি হিসেবে পরিচিত অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ– “পশ্চিম তীর থেকে সব ফিলিস্তিনি বহিষ্কার করে ইহুদি বসতি স্থাপন হোক”
– “গাজাবাসীর ৩টি পথ- মরো, পালাও অথবা আমাদের বশ্যতা স্বীকার করো”।
জনৈক মন্ত্রী– “পারমাণবিক বোমা মেরে ফিলিস্তিনিদের খতম, বাকীদের আয়ারল্যান্ডে পাঠাও”।
– ৩০/১১/’২৩
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি ভয়াবহ বর্বরতা
মুক্তির পথ কী?
দখলদার ইসরায়েল ৭ অক্টোবর ইসলামী ধর্মবাদী হামাসের একটি সামরিক হামলার অজুহাতে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের উপর এক ধারাবাহিক বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের গোলার আঘাত থেকে বাদ পড়ছে না হাসপাতাল, স্কুল, এ্যাম্বুলেন্স, মসজিদ-গীর্জা, আশ্রয় শিবির, শরণার্থী শিবির, অবকাঠামোসহ সকল স্থাপনা। ২৩ লাখ অধিবাসীর ১৪১ বর্গমাইল গাজা উপত্যকাকে এই বর্বর ফ্যাসিস্টরা এক ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫,০০০ নিহত ফিলিস্তিনির মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই নারী ও শিশু। আহত ৩০,০০০’র মধ্যেও ৭৫ শতাংশ নারী-শিশু। নিখোঁজ প্রায় ৬,০০০। নিহতের তালিকায় আছেন জাতিসংঘ কর্মী, সাংবাদিক, ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীও। আইসিইউয়ে থাকা রোগী, ইনকিউবেটরে থাকা শিশুরা, অপারেশনের রোগীরা হাসপাতালে জ্বালানি বা বিদ্যুতের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এসময়ে বাইরে থেকে আসতে দেয়া হয়নি খাদ্য, ওষুধ, তেল-জ্বালানিসহ নিত্য ব্যবহার্য কোনো কিছুই। নেই বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট। সুপেয় পানির উৎসগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ৭৫ শতাংশ ভবন ধ্বংসস্তুপে পরিণত।
সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ
বিশ্বের দেশে দেশে বিবেকবান, প্রগতিশীল/মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক শক্তি এবং জনগণ ইসরায়েলী সন্ত্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এবং ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতি সংহতি-সহমর্মীতা-স্বাধীনতার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাচ্ছেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ছাড়াও রোম, ডেনমার্কের ব্রাব্র্যান্ড, জার্মানির বার্লিন, অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা, নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারসহ বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিনের পতাকা উড়িয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান দেন।
এমনকি সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছে নেতানিয়াহু সরকার যুদ্ধাপরাধ করছে। তার ভাষ্যে– “গাজা শিশুদের জন্য কবরস্থান”। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক একজন কর্মকর্তা গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। তিনি বলেছেন– “যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ ইউরোপের বেশিরভাগ সরকার এ নৃশংস হামলায় জড়িত”।
ফিলিস্তিনে বর্বরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রণালয়ের কর্তা-ব্যক্তিরা পর্যন্ত অনেকেই প্রতিবাদ ও পদত্যাগ করছে। অনেক দেশই গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন, কেউ রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে। এমনকি আমেরিকা-ইউরোপ-বিশ্বের অনেক ইহুদি ব্যক্তি-সংগঠন জায়নবাদী নেতানিয়াহু সরকারের বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
ফিলিস্তিনের প্রত্যক্ষ শত্রু ইসরায়েল ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ
মার্কিনের প্রত্যক্ষ মদদে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি আগ্রাসনে পড়ে। ইসরায়েল অব্যাহতভাবে হত্যা-নির্যাতন ও বাস্তুচ্যূত করে। মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি জায়নবাদীদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যাদের এ অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ইসরায়েলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ষড়যন্ত্র। নিজভূমেই ফিলিস্তিনিরা পরবাসী। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিরা-তো বটেই, বিগত দিনে আরব বিশ্বের কোনো কোনো দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামরিকসহ সার্বিক সহায়তায় ইসরায়েলের কাছে আরবরা প্রতিবারই হেরে গেছে। সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে ধামাচাপা দিয়ে যুদ্ধরত দেশগুলোর মাঝে মিটমাট করেছে মাত্র। আপসবাদী মাহমুদ আব্বাসকে পশ্চিম তীরের আধিকারিক করে ইসরায়েল তার সম্প্রসারণবাদী নীতি ক্রমেই জোরদার করছে। অন্যদিকে গাজাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনকে বানিয়ে তুলেছে উন্মুক্ত কারাগার। সত্যিকার প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিকরা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে ক্রমেই দূর্বল হয়ে পড়ায় তার জায়গায় ইসলামী মৌলবাদী হামাসের উত্থান ঘটেছে। ধর্মবাদী ইহুদি জায়নবাদী ও হামাস ইহুদি-মুসলিমদের মধ্যে চরম সাম্প্রদায়িক বিভক্তির দেয়াল তুলে দিয়েছে। আর এতে মূল মদদদাতা হিসেবে ভূমিকা রাখছে সাম্রাজ্যবাদীরা।
সাম্রাজ্যবাদ ও আরব বিশ্বের ভূমিকা
ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের আগ্রাসী যুদ্ধ প্রায় দুই মাস অতিক্রম করছে। জাতিসংঘ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। মার্কিন সমর্থন ছাড়া জাতিসংঘ যে ঠুঁটো জগন্নাথ– এ পরিস্থিতি তারই প্রকাশ। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনের পোষা কুকুর ইসরায়েলের এ হেন পাশবিক কাজে সাহায্য-মদদ দিয়ে চলেছে মার্কিনসহ পশ্চিমা মিত্ররা। বিপরীতে চীন-রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদীরা ইসরায়েলি বর্বরতা বন্ধের দাবির আড়ালে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্য জোরদারের পাঁয়তারায় ব্যস্ত।
অন্যদিকে আরব বিশ্ব তাদের নিন্দা-মন্দ বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ আরব বিশ্বের ভূমিকা অনেকটা এরকম। মুসলিমসহ বিশ্বের জনগণের বিক্ষুব্ধ মনোভাবের নিরসনে জর্ডান-বাহরাইন-তুরস্ক রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করলেও নেই ওআইসিসহ অন্য আরব দেশগুলোর কঠোর কোনো পদক্ষেপ। লাশের সারি, ধ্বংসস্তুপের তলা থেকে আহতদের গগন বিদারী আর্তনাদ, ভেঙে পড়া চিকিৎসা ব্যবস্থায় আহতদের কাতরানি, ক্ষুধা-পিপাসায় ক্লান্ত গাজার অধিবাসীদের আহাজারি স্বত্ত্বেও তথাকথিত মুসলিম উম্মাহ ধর্না দিচ্ছে চীন-রাশিয়ার কাছে। ইরান কিছুটা উচ্চবাচ্য করলেও তা তাদের সীমার মধ্যে থেকেই। পশ্চিমাদের সন্তুষ্ট রাখতে আরব দেশগুলোর এ হেন নির্লজ্জ-পশ্চিমা তোষণ নীতিই আরব শেখদের বিলাস-ব্যসন-ব্যাভিচারের সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি। মূলত মধ্যপ্রাচ্যে আরব দেশগুলোতে বহাল স্বৈরতন্ত্র-সামরিক শাসন-রাজতন্ত্রের পেছনে আছে পশ্চিমাদের আশীর্বাদ। ফলে আরব রাষ্ট্রগুলো এখন ফিলিস্তিনের স্বার্থ দেখে মার্কিনি চোখে। গাজায় সংঘটিত এবারকার গণহত্যার পূর্বেও প্রায় হাফ ডজন আরব রাষ্ট্রের সাথে ছিল ইসরায়েলের কূটনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক। সৌদি আরবের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আলাপ এ যুদ্ধের কারণে ভেস্তে গেছে। এদের হাত-পা সাম্রাজ্যবাীদদের কাছে বাঁধা। ইসরায়েলের প্রতি আরব বিশ্বের মৃদু সমালোচনা মূলত আরব-মুসলিমসহ বিশ্বজনমতকে ভাওতা দেয়া বৈ অন্য কিছু নয়। আরব বিশ্বের অনুনয়-আবেদন-নিবেদনকে ইসরায়েল ও তার প্রভুরা থোড়াই কেয়ার করে।
হাসিনা, লীগ ও শাসকশ্রেণির ভূমিকা
‘কওমী জননী’ প্রধানমন্ত্রী তার বাকপটুত্তে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিন্দা ও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তার দেখানো পথেই তার মন্ত্রী-এমপি-দলীয় বেনিফিশিয়ারীরা ফিলিস্তিনিদের জন্য মায়া কান্না কেঁদে চলেছে। তারা ফিলিস্তিনের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে দেশীয়-আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের বিরোধীদের কোণঠাসা করার জায়গা থেকে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সেন্টিমেন্টকে তার ফ্যাসিবাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে এ প্রশ্নে হাসিনা সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও বিএনপি’র মৃদু সমালোচনা করছে।
কিন্তু তারা দখলদার ইসরায়েল রাষ্ট্র ধ্বংসের কোনো কথা বলছে না। স্পষ্টভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা ও বিরোধিতা করছে না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের হাত গুটানোর কথা বলছে না। সর্বোপরি মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি নির্বিশেষে সকল ধর্মের জনগণের ঐক্যের কথা বলছে না, একটি ধর্মনিরপেক্ষ অখণ্ড ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার কথাও বলছে না।
ইসরায়েল প্রশ্নে হাসিনা সরকারের দ্বিচারিতার এক বড় নমুনা এদেশীয় পাসপোর্টে ইসরায়েল ভ্রমণে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা উঠিয়ে দেয়া। হাসিনা সরকারের পরম মিত্র ভারত-মোদি ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ দোহাই তুলে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দনীয় ভূমিকা ও বিএনপি’র নীরবতাকে মৃদু সমালোচনা করলেও ভারত প্রশ্নে একেবারে চুপ। দেশে দেশে ইসরায়েলি যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ‘শান্তি সমাবেশ’র নামে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশকারী আওয়ামীলীগ ফিলিস্তিন ইস্যুতে পাঁচ জন লোককেও সমাবেশিত করেনি।
বিরোধী দল বিএনপিও তার নির্বাচনি বৈতরণী পার পাবার স্বার্থে ফিলিস্তিন প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটে আছে প্রভু মার্কিনিদের রুষ্ট হবার ভয়ে।
ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির পথ কী?
সাম্রাজ্যবাদীরা ধর্মের ভিত্তিতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন– এই দুই পৃথক রাষ্ট্রের যে ছবক দিচ্ছে তা হলো প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী কর্মসূচি। এটা হলো ইসরায়েলের দখলদারত্বের স্বীকৃতি ও বৈধতাদান। যদিও এটুকু ছাড় দিতেও ইসরায়েল আন্তরিক নয়।
ফিলিস্তিনি-ইহুদি জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্বিরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী সমাধানকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ-মুক্ত, স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ, অখণ্ড ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কর্মসূচিকে সামনে রেখে সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের ভিত্তিতে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বেই কেবল মাত্র সম্ভব।
ইসরায়েলি মন্ত্রীদের বক্তব্য
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু– “ফিলিস্তিনিরা মানব পশু” (HUMAN ANIMAL) ।
প্রেসিডেন্ট জ্যাক হারজোগ– “গাজার বাসিন্দারা নিষ্পাপ বেসামরিক নাগরিক নন, পুরো জাতিই দায়ী”।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী– “আমরা নরপশুদের সঙ্গে লড়ছি, গাজায় যে গণমৃত্যু শুরু হয়েছে, সেটা কেবল শুরু”।
– “এই যুদ্ধ শুধু হামাসের সঙ্গে নয়, ফিলিস্তিনি সব বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”।
নাৎসীপন্থি হিসেবে পরিচিত অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ– “পশ্চিম তীর থেকে সব ফিলিস্তিনি বহিষ্কার করে ইহুদি বসতি স্থাপন হোক”
– “গাজাবাসীর ৩টি পথ- মরো, পালাও অথবা আমাদের বশ্যতা স্বীকার করো”।
জনৈক মন্ত্রী– “পারমাণবিক বোমা মেরে ফিলিস্তিনিদের খতম, বাকীদের আয়ারল্যান্ডে পাঠাও”।
– ৩০/১১/’২৩
আরও খবর
- শনি
- রোব
- সোম
- মঙ্গল
- বুধ
- বৃহ
- শুক্র