• বৃহঃস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
  • ঢাকা, বাংলাদেশ
শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যুত্থানঃ সফল এবং ব্যর্থ
শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যুত্থানঃ সফল এবং ব্যর্থ

  আন্দোলন প্রতিবেদন  

শনিবার, ৬ আগস্ট ২০২২  |  অনলাইন সংস্করণ

শ্রীলঙ্কায় শাসকশ্রেণির সংকট ও গণঅভ্যুত্থান

দক্ষিণ-এশিয়ায় এক সময়ের উন্নয়ন-মডেল শ্রীলঙ্কায় খাদ্য, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ, পরিবহণ ব্যবস্থা, চিকিৎসা, শিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রতিদিন গড়ে আধা বেলা বিদ্যুৎ থাকছে না। গ্যাস-পেট্রোল কেনার জন্য দুই তিন দিন পর্যন্ত সিরিয়ালে থাকতে হয়। দৈনন্দিন চাহিদার তিনভাগের একভাগ জ্বালানি পাওয়া যাচ্ছে। কাগজের অভাবে সরকারি সার্টিফিকেট পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। এক পর্যায়ে স্কুল কলেজ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। খাদ্য সংকট ও দাম আকাশচুম্বি। বিদেশ থেকে জ্বালানি ও খাদ্য কেনার ডলার নেই।

এ সব কারণে এ বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম দিক থেকেই শ্রীলঙ্কার জনগণ ফ্যাসিস্ট রাজাপক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ফুঁসে উঠেন। তারই তীব্রতার জেরে ৯ মে মাহিন্দর রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আরেক চ্যাম্পিয়ন দুর্নীতিবাজ বিরোধী দলের নেতা রনিল বিক্রমাসিংহেকে (পার্লামেন্টে তার দলের এমপি মাত্র একজন) প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিল প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। যাকে ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের বন্ড কেলেঙ্কারির কারণে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ব্যর্থ অভিযুক্ত করেছিল রাজাপক্ষেরা। সেই বিরোধী দলীয় নেতা রনিলকে প্রধানমন্ত্রী করে রাজাপক্ষেদের পরিবার ও দলকে ক্ষমতায় রাখার অপকৌশল নিয়ে জনরোষানলকে প্রশমিত করেছিল।

কিন্তু জুন’২২-এর শেষ সপ্তাহে শ্রীলঙ্কার গণবিরোধী সরকার জানায় তাদের হাতে মাত্র এক সপ্তাহ চালানোর মতো জ্বালানি  মজুত আছে। এ কারণে ট্রেন, বাসসহ পরিবহণ খাতে এবং স্বাস্থ্য খাতে জ্বালানি সরবরাহ দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। সরকারি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে চিকিৎসক-নার্সরা রাজপথে নেমে আসেন। প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ থাকায় তাদের পক্ষে দৈনন্দিন কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ৯ জুলাই থেকে শ্রীলঙ্কায় পুনরায় গণবিক্ষোভ শুরু হয় এবং গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ঘেরাও দখল হয়। এরই জেরে ১৩ জুলাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে পালিয়ে প্রথমে মালদ্বীপ পরে সিঙ্গাপুর আশ্রয় নিয়ে ১৪ জুলাই পদত্যাগ পত্র পাঠায়। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

শ্রীলঙ্কার জনগণের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহেকে রাজাপাক্ষেদের দলের (শ্রীলঙ্কা পডুজানা পেরামুনা) সাংসদরা গত ২০ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। এই রনিল বিক্রমাসিংহেও সাম্রাজ্যবাদের দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের আরেক প্রতিনিধি। রনিল পশ্চিমাপন্থি হিসেবে পরিচিত। রনিলকে মেনে নিতে অস্বীকার করে বিক্ষোভকারীদের একাংশ। তারা রনিলকে রাজাপাক্ষেদের কর্মচারী হিসেবেই দেখছেন। রনিলকে সমর্থন করেছে দেশে থাকা সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দর রাজাপক্ষে। তাই রনিলের পদত্যাগ চেয়েও বিক্ষোভ চলতে থাকে। কিন্তু রনিল তাদের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি দেয়। ২০ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই জরুরি অবস্থা জারি করে বিক্ষোভ দমনের নির্দেশ দেয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যরা যৌথ অভিযান চালিয়ে প্রেসিডেন্টের দপ্তর ও আশেপাশের এলাকা থেকে বিক্ষোভকারীদের নির্যাতন এবং গ্রেপ্তার করে হটিয়ে দেয়। যদিও বিক্ষোভকারীরা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেয়। কিন্তু জনগণের বিক্ষোভ আপাত হলেও স্তিমিত হয়ে পড়েছে।

সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর ‘উন্নয়ন’ শ্রীলঙ্কায় বিপর্যয় ডেকে আনলো

শ্রীলঙ্কার এই পরিণতির মূল কারণ দালাল রাজাপক্ষে সরকারের সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর তথাকথিত উন্নয়ন। শ্রীলঙ্কার যে উন্নয়ন বিগত কিছু বছরে দেখা গিয়েছিল সেটা কোনো টেকসই জাতীয় উন্নয়ন ছিল না। তাদের ডলার আয়ের প্রধান দুটো খাত ছিল পর্যটন ও রেমিটেন্সÑ যা পুরোপুরিই সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর। এর উপর ভর করে তারা বিপুল বৈদেশিক ঋণ নিয়ে নানান চমক দেখাতে চেয়েছে। গভীর সমুদ্র বন্দর, চোখধাঁধানো বিমানবন্দর এবং উন্নত সমরাস্ত্র দেখিয়ে জনগণকে ধারণা দেয়া হয়েছিল তারা নিম্নমাধ্যম আয়ের থেকে ধনীদেশের মতো হয়েছে। যেমনটা আমাদের দেশের হাসিনা সরকার বলছে।

এই অর্থনৈতিক ধারার অনিবার্য অংশ ছিল রাজাপক্ষেদের পরিবারতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র। সংবিধানে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতার জোরে আত্মীয়-স্বজনরাই বিভিন্ন পদে আসীন হয়েছিল। যাতে দুর্নীতি, যথেচ্ছ লুটপাট এবং জনগণের সম্পদ তছরুপ করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে জিডিপির ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতো এই পরিবার। শ্রীলঙ্কান সরকার কৃষিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাড় না করে খাদ্য আমদানির উপর নির্ভরশীল করে ফেলেছিল এবং পর্যটন খাতকে প্রচুর প্রাধান্য দিয়েছিল। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে পর্যটনে ধ্বস নেমেছিল। অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাপক ব্যয় করেছে। তাদের ক্ষমতাবলে মেগা মেগা প্রজেক্ট করে মেগা দুর্নীতি কায়েম করেছিল রাজাপক্ষে পরিবার ও সরকার। এ সবের জন্য ঋণ দিয়েছে চীনসহ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীরা এবং ভারত।

২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণ ছিল মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলার। সেটা এক যুগের মধ্যে তিনগুণ ছাড়িয়ে গেছে। ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণগ্রস্ত দেশটিকে এ বছর ৭.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করার কথা। এক সময় শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ফুলে ফেঁপে ৩,৮০০ মার্কিন ডালারে উন্নীত হয়েছে বলা হয়েছিল। যা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের চাইতেও অধিক। কিন্তু উন্নয়নের হাওয়াই বেলুন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেছে। কারণ এই উন্নয়ন আত্মনির্ভরশীল উন্নয়ন ছিল না। এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর উন্নয়ন। সাম্রাজ্যবাদীরা এই মডেল সাধারণত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বাস্তবায়ন করে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদ দালাল সরকারগুলোকে মদদ জুগিয়ে পুরো দেশের অর্থনীতিকে তাদের দালাল মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কুক্ষিগত করে। দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াশ্রেণি এটি করে সাম্রাজ্যবাদ এবং নিজ শ্রেণি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে। যার দুর্ভোগ জনগণকেই পোহাতে হয়/হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কা ঘিরে সাম্রাজ্যবাদী-সম্প্রসারণবাদীদের দ্বন্দ্ব

উদ্ভূত পদক্ষেপ এবং অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা

শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র শক্তি ইইউ। রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রসিডেন্ট হয়েই চীনা প্রভাব কমানোর জন্য মার্কিন এবং তাদের মিত্রদের দিকে ঝুঁকছে। ইতিমধ্যে সে আইএমএফ-এর সাথে নতুন ঋণের জন্য আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু চীন-জাপান-ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় সহায়তার ওপরও জোর দিচ্ছে। যেহেতু চীনাপন্থি রাজাপক্ষেরা রনিলকে প্রেসিডেন্ট এবং তাদের দলের নেতা দিনেশ গুনাবর্ধনকে প্রধানমন্ত্রী করেছে অর্থাৎ রাজাপক্ষেদের দলই ক্ষমতাসীন, তাই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন-পিং এই সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। শ্রীলঙ্কায় নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর অভিপ্রায়ে ভারতও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।

অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা পরিণত হয়েছে ভারত এবং পশ্চিমা ও প্রাচ্য সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক উর্বর ক্ষেত্র। প্রত্যেকে নিজ নিজ এজেন্ডা নিয়ে আগাচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয় ঠিক রয়েছে। তাহলো বিদেশ-নির্ভরতা। সেটা বরং আরো বিপজ্জনক ভাবে বাড়িয়ে তোলার পদক্ষেপ নিচ্ছে বর্তমান সরকার।

গত ১৮ জুলাই ভারতের মোদি সরকার বৈঠক করে শ্রীলঙ্কাকে প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থসাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের ভূমিকা নিয়ে চীন এখন উদ্বিগ্ন। শ্রীলঙ্কা প্রশ্নে ভারতের ভূমিকার বিপরীতে চীনের রাষ্ট্রদূত দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে হিন্দু তামিল ও মুসলমান তামিলদের এলাকা সফর করেছে। সর্ব উত্তরে হিন্দু মন্দিরে চীনা রাষ্ট্রদূতকে পূজা দিতেও দেখা গেছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সেখানে তার প্রভাব-নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির জন্য হাত বাড়াচ্ছে। অবশ্যই তা শর্তসাপেক্ষে। রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আইএমএফ, এডিবি, জাপানসহ অনেক দেশ শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু তারা এই সাহায্যের জন্য যে শর্ত জুড়ে দিয়েছে তাহলো- কর বাড়ানো, ভর্তুকী কমিয়ে দেওয়া, উন্নয়ন খাতে ব্যয় কমানো (চীনের প্রভাব-নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করা), লোকসানি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করা- ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে ‘চুক্তি’ও করা হবে শিগগিরই।

এগুলো জনগণের মাথায় বোঝার উপর শাকের আঁটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ এখনি বলতে শুরু করেছেন যে আইএমএফ-এর বেইল আউট জনগণের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ তাদের প্রস্তাবিত কঠোর করহার জনগণকেই বহন করতে হবে। এরই মধ্যে ২১ জুলাই রেলের ভাড়া বৃদ্ধি এবং খাবারের দাম বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, কৃষি উৎপাদন আরো ব্যয়বহুল হবে, চাকুরি বাজার সংকুচিত হবে এবং জ্বালানির দামও বাড়বে। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত যা দিচ্ছে তা দিচ্ছে রয়ে সয়েÑ অল্প সল্প খাবার এবং ঔষধ ইত্যাদি। বিশ্বব্যাংক নিশ্চিত হতে পারছে না চীনা সমর্থন ও পরিকল্পনার যে প্রশাসন দেশটি শাসন করেছে তারা টিকে থাকা পর্যন্ত তাদের প্রেসক্রিপশন এবং পরিকল্পনা মতো বর্তমান শাসকরা কাজ করবে কি না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায় একটি গণঅভ্যুত্থান হয়ে ব্যক্তি মাহিন্দর ও গোতাবায়ার পরিবর্তন হলেও সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ, দালাল শাকশ্রেণি বহাল তবিয়তেই রয়েছে। জনগণ তাদের খপ্পর থেকে মুক্তি পায়নি।

কেন শ্রীলঙ্কার গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হলো?

সাম্রাজ্যবাদের দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষমতা ও তাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তন হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান হাতিয়ার সেনাবাহিনীও রনিল বিক্রমাসিংহের পক্ষে। মূলত রনিল গোতাবায়া রাজাপক্ষের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। মাহিন্দ্রর রাজাপক্ষেও রনিলকে সমর্থন দিয়ে আন্দোলনকারীদের ঘরে ফিরে যেতে বলেছে। রাজাপক্ষেদের দলই মূলত ক্ষমতায় রয়েছে। এই আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মসূচিও ছিল না। ফলে সমাজ-ব্যবস্থার বা অর্থনৈতিক রূপান্তেেরর কোনো প্রগতিশীল কর্মসূচি এতে ছিল না। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-তরুণ ও বিপুল জনগণ এতে অংশ নিলেও বাম নামধারী ট্রটস্কিপন্থি বা এ ধরনের বামদের প্রভাবে এ আন্দোলন পরিণত হয় ব্যক্তি রাজাপক্ষে বা গোতাবায়া সরানোর সংগ্রামে।

মুক্তির পথ কী?

শ্রীলঙ্কার জনগণের অভ্যুত্থান আরেকবার প্রমাণ করেছে মাওবাদী আদর্শে বিপ্লবী কর্মসূচি না থাকলে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিপ্লবী প্রক্রিয়া/পথ না থাকলে শেষ-পর্যন্ত জনগণ ব্যর্থ হতে বাধ্য। ২০১২ সালে আরব বসন্ত গণক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। যেমন কিনা ৬৯ ও ৭১-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৯০-৯১ এ এরশাদ বিরোধী গণ-আন্দোলনেও বাংলাদেশের জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

এর কারণ হলো, শাসকশ্রেণির কিছু ব্যক্তিকে সরিয়ে বা সাম্রাজ্যবাদের এক পক্ষ সরিয়ে অন্য পক্ষকে প্রাধান্য দিলে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর অর্থনীতি ও সমাজ-ব্যবস্থার পরিবর্তন হয় না। তারা যা করে তাহলো, সাম্রাজ্যবাদী সংকটের সাম্রাজ্যবাদী সমাধান। যার প্রকাশ ঘটে এক ব্যক্তির বদলে অন্য ব্যক্তিকে আনা, এক পার্টির বদলে অন্য পার্টি আনা। প্রয়োজনে জরুরি অবস্থা, সামরিক শাসন, এমনকি বিদেশি প্রভুদের সামরিক আগ্রাসনের সহায়তায় সশস্ত্রভাবে জনগণের অভ্যুত্থানকে দমন করা। শ্রীলঙ্কায় এটা শুরু হয়েছে। প্রয়োজনে ‘গণতন্ত্র’-র নামে নতুন কোনো ভোটের কানাগলিতে জনগণকে নিয়ে যাওয়া, যাতে বুর্জোয়া পার্টি ও সংশোধনবাদীরা ব্যবস্থাকে সহায়তা করে। শ্রীলঙ্কায় এটাও দেখা গেলো সংসদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বারা।

এই ব্যবস্থা টিকে থাকে তার রাষ্ট্রযন্ত্রের জোরে, প্রধানত তার সশস্ত্র শক্তি ও আমলাতন্ত্রের জোরে। তাই, এর বিপরীতে জনগণের নিজস্ব সশস্ত্র শক্তি গড়ে তোলার প্রশ্নটি হলো জনগণের দিক থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কেন্দ্রীয় প্রশ্ন।

শ্রীলঙ্কার অভ্যুত্থানে এসবেরই অভাব ছিল।

এ সম্পর্কে সচেতন না থেকে নিরামিষ গণঅভ্যুত্থানের পথে চললে জনগণের কোনো ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা হবে না।

তবু জনগণ বারবার আন্দোলন করবেন

কিন্তু তার থেকে অর্জন ও শিক্ষা নেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ

শ্রীলঙ্কার জনগণ ব্যর্থ হলেন অর্থ এটা নয় যে, এ অভ্যুত্থানের কোনো অর্জন নেই। জনগণের প্রতিটি আন্দোলন, বিশেষত রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের গুরুত্ব রয়েছে। জনগণ আশু কিছু সংস্কার পেয়ে থাকেন বটে। কিন্তু সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের উত্থান, জাগরণ, রাজনৈতিক ঝঞ্ঝায় ঢুকে পড়া, সচেতন হয়ে ওঠা এবং আন্দোলনের থেকে যদি সম্ভব হয় বিপ্লবী শিক্ষাটি নেয়া।

আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি শুধু শ্রীলঙ্কায় টর্নেডো নামিয়ে এনেছে তা নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এর ঝাপটা ইতিমধ্যেই পড়ছে। ইউক্রেন-যুদ্ধে আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে, এবং তারই ফলশ্রুতিতে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর উন্নয়নের বেলুন যেভাবে ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছে সর্বত্র তাতে জন-আন্দোলন আরো হবে, অন্যান্য দেশে এবং শ্রীলঙ্কাতেও। মুৎসুদ্দি শাসক শ্রেণি, যারা সাম্রাজ্যবাদী উন্নয়নের প্রেসক্রিপশনে লুটপাট করে চলেছে, এবং জনগণকে বুদ্ধু বানিয়ে রেখেছে, তাদের হৃদকম্প শোনা যাচ্ছে। সুতরাং এই রাউন্ডের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর জন্য লাইনগত-রাজনৈতিক প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে তার ফল সবটাই শাসকদের পকেটেই গিয়ে না ঢোকে। সেটা আমাদের দেশেও প্রযোজ্য।

শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যুত্থানঃ সফল এবং ব্যর্থ

 আন্দোলন প্রতিবেদন 
শনিবার, ৬ আগস্ট ২০২২  |  অনলাইন সংস্করণ

শ্রীলঙ্কায় শাসকশ্রেণির সংকট ও গণঅভ্যুত্থান

দক্ষিণ-এশিয়ায় এক সময়ের উন্নয়ন-মডেল শ্রীলঙ্কায় খাদ্য, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ, পরিবহণ ব্যবস্থা, চিকিৎসা, শিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রতিদিন গড়ে আধা বেলা বিদ্যুৎ থাকছে না। গ্যাস-পেট্রোল কেনার জন্য দুই তিন দিন পর্যন্ত সিরিয়ালে থাকতে হয়। দৈনন্দিন চাহিদার তিনভাগের একভাগ জ্বালানি পাওয়া যাচ্ছে। কাগজের অভাবে সরকারি সার্টিফিকেট পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। এক পর্যায়ে স্কুল কলেজ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। খাদ্য সংকট ও দাম আকাশচুম্বি। বিদেশ থেকে জ্বালানি ও খাদ্য কেনার ডলার নেই।

এ সব কারণে এ বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম দিক থেকেই শ্রীলঙ্কার জনগণ ফ্যাসিস্ট রাজাপক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ফুঁসে উঠেন। তারই তীব্রতার জেরে ৯ মে মাহিন্দর রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আরেক চ্যাম্পিয়ন দুর্নীতিবাজ বিরোধী দলের নেতা রনিল বিক্রমাসিংহেকে (পার্লামেন্টে তার দলের এমপি মাত্র একজন) প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিল প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। যাকে ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের বন্ড কেলেঙ্কারির কারণে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ব্যর্থ অভিযুক্ত করেছিল রাজাপক্ষেরা। সেই বিরোধী দলীয় নেতা রনিলকে প্রধানমন্ত্রী করে রাজাপক্ষেদের পরিবার ও দলকে ক্ষমতায় রাখার অপকৌশল নিয়ে জনরোষানলকে প্রশমিত করেছিল।

কিন্তু জুন’২২-এর শেষ সপ্তাহে শ্রীলঙ্কার গণবিরোধী সরকার জানায় তাদের হাতে মাত্র এক সপ্তাহ চালানোর মতো জ্বালানি  মজুত আছে। এ কারণে ট্রেন, বাসসহ পরিবহণ খাতে এবং স্বাস্থ্য খাতে জ্বালানি সরবরাহ দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। সরকারি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে চিকিৎসক-নার্সরা রাজপথে নেমে আসেন। প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ থাকায় তাদের পক্ষে দৈনন্দিন কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ৯ জুলাই থেকে শ্রীলঙ্কায় পুনরায় গণবিক্ষোভ শুরু হয় এবং গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ঘেরাও দখল হয়। এরই জেরে ১৩ জুলাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে পালিয়ে প্রথমে মালদ্বীপ পরে সিঙ্গাপুর আশ্রয় নিয়ে ১৪ জুলাই পদত্যাগ পত্র পাঠায়। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

শ্রীলঙ্কার জনগণের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহেকে রাজাপাক্ষেদের দলের (শ্রীলঙ্কা পডুজানা পেরামুনা) সাংসদরা গত ২০ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। এই রনিল বিক্রমাসিংহেও সাম্রাজ্যবাদের দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের আরেক প্রতিনিধি। রনিল পশ্চিমাপন্থি হিসেবে পরিচিত। রনিলকে মেনে নিতে অস্বীকার করে বিক্ষোভকারীদের একাংশ। তারা রনিলকে রাজাপাক্ষেদের কর্মচারী হিসেবেই দেখছেন। রনিলকে সমর্থন করেছে দেশে থাকা সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দর রাজাপক্ষে। তাই রনিলের পদত্যাগ চেয়েও বিক্ষোভ চলতে থাকে। কিন্তু রনিল তাদের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি দেয়। ২০ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই জরুরি অবস্থা জারি করে বিক্ষোভ দমনের নির্দেশ দেয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যরা যৌথ অভিযান চালিয়ে প্রেসিডেন্টের দপ্তর ও আশেপাশের এলাকা থেকে বিক্ষোভকারীদের নির্যাতন এবং গ্রেপ্তার করে হটিয়ে দেয়। যদিও বিক্ষোভকারীরা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেয়। কিন্তু জনগণের বিক্ষোভ আপাত হলেও স্তিমিত হয়ে পড়েছে।

সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর ‘উন্নয়ন’ শ্রীলঙ্কায় বিপর্যয় ডেকে আনলো

শ্রীলঙ্কার এই পরিণতির মূল কারণ দালাল রাজাপক্ষে সরকারের সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর তথাকথিত উন্নয়ন। শ্রীলঙ্কার যে উন্নয়ন বিগত কিছু বছরে দেখা গিয়েছিল সেটা কোনো টেকসই জাতীয় উন্নয়ন ছিল না। তাদের ডলার আয়ের প্রধান দুটো খাত ছিল পর্যটন ও রেমিটেন্সÑ যা পুরোপুরিই সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর। এর উপর ভর করে তারা বিপুল বৈদেশিক ঋণ নিয়ে নানান চমক দেখাতে চেয়েছে। গভীর সমুদ্র বন্দর, চোখধাঁধানো বিমানবন্দর এবং উন্নত সমরাস্ত্র দেখিয়ে জনগণকে ধারণা দেয়া হয়েছিল তারা নিম্নমাধ্যম আয়ের থেকে ধনীদেশের মতো হয়েছে। যেমনটা আমাদের দেশের হাসিনা সরকার বলছে।

এই অর্থনৈতিক ধারার অনিবার্য অংশ ছিল রাজাপক্ষেদের পরিবারতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র। সংবিধানে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতার জোরে আত্মীয়-স্বজনরাই বিভিন্ন পদে আসীন হয়েছিল। যাতে দুর্নীতি, যথেচ্ছ লুটপাট এবং জনগণের সম্পদ তছরুপ করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে জিডিপির ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতো এই পরিবার। শ্রীলঙ্কান সরকার কৃষিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাড় না করে খাদ্য আমদানির উপর নির্ভরশীল করে ফেলেছিল এবং পর্যটন খাতকে প্রচুর প্রাধান্য দিয়েছিল। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে পর্যটনে ধ্বস নেমেছিল। অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাপক ব্যয় করেছে। তাদের ক্ষমতাবলে মেগা মেগা প্রজেক্ট করে মেগা দুর্নীতি কায়েম করেছিল রাজাপক্ষে পরিবার ও সরকার। এ সবের জন্য ঋণ দিয়েছে চীনসহ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীরা এবং ভারত।

২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণ ছিল মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলার। সেটা এক যুগের মধ্যে তিনগুণ ছাড়িয়ে গেছে। ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণগ্রস্ত দেশটিকে এ বছর ৭.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করার কথা। এক সময় শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ফুলে ফেঁপে ৩,৮০০ মার্কিন ডালারে উন্নীত হয়েছে বলা হয়েছিল। যা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের চাইতেও অধিক। কিন্তু উন্নয়নের হাওয়াই বেলুন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেছে। কারণ এই উন্নয়ন আত্মনির্ভরশীল উন্নয়ন ছিল না। এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর উন্নয়ন। সাম্রাজ্যবাদীরা এই মডেল সাধারণত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বাস্তবায়ন করে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদ দালাল সরকারগুলোকে মদদ জুগিয়ে পুরো দেশের অর্থনীতিকে তাদের দালাল মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কুক্ষিগত করে। দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াশ্রেণি এটি করে সাম্রাজ্যবাদ এবং নিজ শ্রেণি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে। যার দুর্ভোগ জনগণকেই পোহাতে হয়/হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কা ঘিরে সাম্রাজ্যবাদী-সম্প্রসারণবাদীদের দ্বন্দ্ব

উদ্ভূত পদক্ষেপ এবং অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা

শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র শক্তি ইইউ। রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রসিডেন্ট হয়েই চীনা প্রভাব কমানোর জন্য মার্কিন এবং তাদের মিত্রদের দিকে ঝুঁকছে। ইতিমধ্যে সে আইএমএফ-এর সাথে নতুন ঋণের জন্য আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু চীন-জাপান-ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় সহায়তার ওপরও জোর দিচ্ছে। যেহেতু চীনাপন্থি রাজাপক্ষেরা রনিলকে প্রেসিডেন্ট এবং তাদের দলের নেতা দিনেশ গুনাবর্ধনকে প্রধানমন্ত্রী করেছে অর্থাৎ রাজাপক্ষেদের দলই ক্ষমতাসীন, তাই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন-পিং এই সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। শ্রীলঙ্কায় নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর অভিপ্রায়ে ভারতও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।

অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা পরিণত হয়েছে ভারত এবং পশ্চিমা ও প্রাচ্য সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক উর্বর ক্ষেত্র। প্রত্যেকে নিজ নিজ এজেন্ডা নিয়ে আগাচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয় ঠিক রয়েছে। তাহলো বিদেশ-নির্ভরতা। সেটা বরং আরো বিপজ্জনক ভাবে বাড়িয়ে তোলার পদক্ষেপ নিচ্ছে বর্তমান সরকার।

গত ১৮ জুলাই ভারতের মোদি সরকার বৈঠক করে শ্রীলঙ্কাকে প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থসাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের ভূমিকা নিয়ে চীন এখন উদ্বিগ্ন। শ্রীলঙ্কা প্রশ্নে ভারতের ভূমিকার বিপরীতে চীনের রাষ্ট্রদূত দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে হিন্দু তামিল ও মুসলমান তামিলদের এলাকা সফর করেছে। সর্ব উত্তরে হিন্দু মন্দিরে চীনা রাষ্ট্রদূতকে পূজা দিতেও দেখা গেছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সেখানে তার প্রভাব-নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির জন্য হাত বাড়াচ্ছে। অবশ্যই তা শর্তসাপেক্ষে। রনিল বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আইএমএফ, এডিবি, জাপানসহ অনেক দেশ শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু তারা এই সাহায্যের জন্য যে শর্ত জুড়ে দিয়েছে তাহলো- কর বাড়ানো, ভর্তুকী কমিয়ে দেওয়া, উন্নয়ন খাতে ব্যয় কমানো (চীনের প্রভাব-নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করা), লোকসানি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করা- ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে ‘চুক্তি’ও করা হবে শিগগিরই।

এগুলো জনগণের মাথায় বোঝার উপর শাকের আঁটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ এখনি বলতে শুরু করেছেন যে আইএমএফ-এর বেইল আউট জনগণের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ তাদের প্রস্তাবিত কঠোর করহার জনগণকেই বহন করতে হবে। এরই মধ্যে ২১ জুলাই রেলের ভাড়া বৃদ্ধি এবং খাবারের দাম বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, কৃষি উৎপাদন আরো ব্যয়বহুল হবে, চাকুরি বাজার সংকুচিত হবে এবং জ্বালানির দামও বাড়বে। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত যা দিচ্ছে তা দিচ্ছে রয়ে সয়েÑ অল্প সল্প খাবার এবং ঔষধ ইত্যাদি। বিশ্বব্যাংক নিশ্চিত হতে পারছে না চীনা সমর্থন ও পরিকল্পনার যে প্রশাসন দেশটি শাসন করেছে তারা টিকে থাকা পর্যন্ত তাদের প্রেসক্রিপশন এবং পরিকল্পনা মতো বর্তমান শাসকরা কাজ করবে কি না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায় একটি গণঅভ্যুত্থান হয়ে ব্যক্তি মাহিন্দর ও গোতাবায়ার পরিবর্তন হলেও সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ, দালাল শাকশ্রেণি বহাল তবিয়তেই রয়েছে। জনগণ তাদের খপ্পর থেকে মুক্তি পায়নি।

কেন শ্রীলঙ্কার গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হলো?

সাম্রাজ্যবাদের দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষমতা ও তাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তন হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান হাতিয়ার সেনাবাহিনীও রনিল বিক্রমাসিংহের পক্ষে। মূলত রনিল গোতাবায়া রাজাপক্ষের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। মাহিন্দ্রর রাজাপক্ষেও রনিলকে সমর্থন দিয়ে আন্দোলনকারীদের ঘরে ফিরে যেতে বলেছে। রাজাপক্ষেদের দলই মূলত ক্ষমতায় রয়েছে। এই আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মসূচিও ছিল না। ফলে সমাজ-ব্যবস্থার বা অর্থনৈতিক রূপান্তেেরর কোনো প্রগতিশীল কর্মসূচি এতে ছিল না। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-তরুণ ও বিপুল জনগণ এতে অংশ নিলেও বাম নামধারী ট্রটস্কিপন্থি বা এ ধরনের বামদের প্রভাবে এ আন্দোলন পরিণত হয় ব্যক্তি রাজাপক্ষে বা গোতাবায়া সরানোর সংগ্রামে।

মুক্তির পথ কী?

শ্রীলঙ্কার জনগণের অভ্যুত্থান আরেকবার প্রমাণ করেছে মাওবাদী আদর্শে বিপ্লবী কর্মসূচি না থাকলে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিপ্লবী প্রক্রিয়া/পথ না থাকলে শেষ-পর্যন্ত জনগণ ব্যর্থ হতে বাধ্য। ২০১২ সালে আরব বসন্ত গণক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। যেমন কিনা ৬৯ ও ৭১-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৯০-৯১ এ এরশাদ বিরোধী গণ-আন্দোলনেও বাংলাদেশের জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

এর কারণ হলো, শাসকশ্রেণির কিছু ব্যক্তিকে সরিয়ে বা সাম্রাজ্যবাদের এক পক্ষ সরিয়ে অন্য পক্ষকে প্রাধান্য দিলে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর অর্থনীতি ও সমাজ-ব্যবস্থার পরিবর্তন হয় না। তারা যা করে তাহলো, সাম্রাজ্যবাদী সংকটের সাম্রাজ্যবাদী সমাধান। যার প্রকাশ ঘটে এক ব্যক্তির বদলে অন্য ব্যক্তিকে আনা, এক পার্টির বদলে অন্য পার্টি আনা। প্রয়োজনে জরুরি অবস্থা, সামরিক শাসন, এমনকি বিদেশি প্রভুদের সামরিক আগ্রাসনের সহায়তায় সশস্ত্রভাবে জনগণের অভ্যুত্থানকে দমন করা। শ্রীলঙ্কায় এটা শুরু হয়েছে। প্রয়োজনে ‘গণতন্ত্র’-র নামে নতুন কোনো ভোটের কানাগলিতে জনগণকে নিয়ে যাওয়া, যাতে বুর্জোয়া পার্টি ও সংশোধনবাদীরা ব্যবস্থাকে সহায়তা করে। শ্রীলঙ্কায় এটাও দেখা গেলো সংসদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বারা।

এই ব্যবস্থা টিকে থাকে তার রাষ্ট্রযন্ত্রের জোরে, প্রধানত তার সশস্ত্র শক্তি ও আমলাতন্ত্রের জোরে। তাই, এর বিপরীতে জনগণের নিজস্ব সশস্ত্র শক্তি গড়ে তোলার প্রশ্নটি হলো জনগণের দিক থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কেন্দ্রীয় প্রশ্ন।

শ্রীলঙ্কার অভ্যুত্থানে এসবেরই অভাব ছিল।

এ সম্পর্কে সচেতন না থেকে নিরামিষ গণঅভ্যুত্থানের পথে চললে জনগণের কোনো ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা হবে না।

তবু জনগণ বারবার আন্দোলন করবেন

কিন্তু তার থেকে অর্জন ও শিক্ষা নেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ

শ্রীলঙ্কার জনগণ ব্যর্থ হলেন অর্থ এটা নয় যে, এ অভ্যুত্থানের কোনো অর্জন নেই। জনগণের প্রতিটি আন্দোলন, বিশেষত রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের গুরুত্ব রয়েছে। জনগণ আশু কিছু সংস্কার পেয়ে থাকেন বটে। কিন্তু সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের উত্থান, জাগরণ, রাজনৈতিক ঝঞ্ঝায় ঢুকে পড়া, সচেতন হয়ে ওঠা এবং আন্দোলনের থেকে যদি সম্ভব হয় বিপ্লবী শিক্ষাটি নেয়া।

আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি শুধু শ্রীলঙ্কায় টর্নেডো নামিয়ে এনেছে তা নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এর ঝাপটা ইতিমধ্যেই পড়ছে। ইউক্রেন-যুদ্ধে আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে, এবং তারই ফলশ্রুতিতে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর উন্নয়নের বেলুন যেভাবে ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছে সর্বত্র তাতে জন-আন্দোলন আরো হবে, অন্যান্য দেশে এবং শ্রীলঙ্কাতেও। মুৎসুদ্দি শাসক শ্রেণি, যারা সাম্রাজ্যবাদী উন্নয়নের প্রেসক্রিপশনে লুটপাট করে চলেছে, এবং জনগণকে বুদ্ধু বানিয়ে রেখেছে, তাদের হৃদকম্প শোনা যাচ্ছে। সুতরাং এই রাউন্ডের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর জন্য লাইনগত-রাজনৈতিক প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে তার ফল সবটাই শাসকদের পকেটেই গিয়ে না ঢোকে। সেটা আমাদের দেশেও প্রযোজ্য।

আরও খবর
 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র