• বৃহঃস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
  • ঢাকা, বাংলাদেশ
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতির বিরুদ্ধে দেশে দেশে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তুলুন
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতির বিরুদ্ধে দেশে দেশে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তুলুন

  আন্দোলন প্রতিবেদন  

শুক্রবার, ১২ মে ২০২৩  |  অনলাইন সংস্করণ

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ যুদ্ধ শুধুমাত্র রাশিয়া-ইউক্রেন দু’পক্ষের ভেতরকার কোনো সংঘাত নয়। যুদ্ধ যতই দীর্ঘায়িত হচ্ছে দিনকে দিন তা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পশ্চিমা পরাশক্তি সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের সাথে রুশ সাম্রাজ্যবাদের তীব্র দ্বন্দ্বের প্রতিফলন এ লড়াই। আর এখানে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের দাবার ঘুঁটি হয়েছে ইউক্রেন তথা ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ। এতে সামনে থেকে ক্লাউনের ভূমিকা নিয়েছে পশ্চিমা পাপেট জেলেনস্কি।

যুদ্ধের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে ব্যাপক প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি, অপচয়, বিশেষত: ইউক্রেন জুড়ে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর ঘটনা ঘটছে যার প্রধান শিকার হচ্ছেন নারী-শিশুসহ বৃদ্ধরা। জাতিসংঘের মতে এ পর্যন্ত ৮,০০০ বেসামরিক ইউক্রেনীয় প্রাণ হারিয়েছেন। সারা পৃথিবীর কোথাও কোথাও যখন তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে তখন এক আমেরিকাই ইউক্রেনকে ৮০ বিলিয়ন ডলারের (প্রায় ৯ লক্ষ কোটি টাকা) সামরিকসহ অন্যান্য খাতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সাহায্যের একটা বড় অংশই ইতোমধ্যে ইউক্রেনে পৌঁছেছে। তাদের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী মিত্ররাও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহায়তা করছে জেলেনস্কিকে, যার প্রধান অংশই ব্যয় হচ্ছে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র খাতে। তারা ক্রমবর্ধিত ভাবে আধুনিক সামরিক যান জেলেনস্কি সরকারকে পাঠাচ্ছে। যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদীরা এ যুদ্ধে তাদের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের কার্যকারিতার পরীক্ষা চালাচ্ছে। আর অস্ত্র-শিল্পগুলো লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা লুটছে।

এ যুদ্ধের উত্তাপে শুধু ইউক্রেন নয়, পুড়ছে গোটা দুনিয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন সারা বিশ্বে জ্বালানি ও খাদ্যশস্যের অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হওয়ায় যুদ্ধের ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত, বাণিজ্যিক নানা বিধিনিষেধ ও পরিবহণ/রপ্তানিতে নানান বাধা দরিদ্র দেশগুলোতে তীব্র খাদ্য সংকট সৃষ্টি করেছে। মুদ্রাস্ফীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলস্বরূপ সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির উন্নয়নের মডেল শ্রীলঙ্কা এখনও দেউলিয়াত্ব কাটিয়ে উঠতে পারে নি। পাকিস্তানও সে পথের যাত্রী। আর আফ্রিকার মতো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত গরিব দেশগুলোতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আগাম বার্তা শোনাচ্ছে খোদ জাতিসংঘই। ধনী দেশগুলোতেও মূল্যস্ফীতি সেখানকার সাধারণ বাসিন্দাদের অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নেই। যুদ্ধ-নির্মমতা ছাড়াও রাষ্ট্র-সরকার-লুটেরা ব্যবসায়ীদের সীমাহীন মুনাফার বলি হতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। ইতোমধ্যে শতকরা ৭১ ভাগ জনগণ খাবারের পেছনে অর্থ ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন।

বিশ্বব্যাপী জনগণের এ ভোগান্তির জন্য দায়ী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সাথে সাথে তার অর্থনীতি। গত শতকের ’৯০-এর পর এক মেরু বিশ্বের উদ্ভব হলে পশ্চিমারা বিশ্বায়ন বা গ্লোবাল ভিলেজের যে তত্ত্ব এনেছিল এ তারই কুফল। সাম্রাজ্যবাদী প্রেসক্রিপশনে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মৌলিক শিল্প ক্রমান্বয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়, অনেকটা আমাদের দেশের পাট-চিনি শিল্পের মতো করে। এমনকি আধুনিকায়নের নামে স্ব স্ব দেশের কৃষিটাও করে ফেলা হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি নির্ভর। নিজস্ব স্বাধীন অর্থনীতির বদলে গার্মেন্টস, ট্যুরিজম, অবকাঠামোগত খাতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগ কিংবা প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিটেন্সের মতো সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর শিল্প বা অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে। তৃতীয় বিশ্বের মুৎসুদ্দি শাসক শ্রেণি তাই সাম্রাজ্যবাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বেড়াজালে বন্দি। মূলত সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল শাসকশ্রেণির অর্থনীতির কেন্দ্রে থাকে তাদের মুনাফা-লুটপাট; জনগণের চাহিদা বা দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি সেখানে আদৌ বিবেচ্য নয়। ফলে বাকপটু হাসিনা ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা’র বুলি ঝাড়লেও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই পেড়ে। 

এর ঠিক বিপরীত চিত্র আমরা দেখি গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত দেশে। তখন সারা পৃথিবী অর্থনৈতিক মন্দার বলি হলেও প্রাক্তন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক (বর্তমান রাশিয়া) অর্থনীতির অগ্রগতি তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সমগ্র পুঁজিবাদী বিশ্বকে। সারা বিশ্বের নিপীড়িত, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয়। পুঁজিবাদের  বিপরীতে সমাজতন্ত্র সারা বিশ্বের পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী, লগ্নিকারী, লুটেরাদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়। 

আজ যখন ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদীরা প্রচণ্ড উন্মত্ততায় পৃথিবীকে ভাগ ভাটোয়ারা করতে বিশ্বযুদ্ধের ছক কষছে, তখন পৃথিবীতে কোথাও কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই। যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে এ হেন যুদ্ধ উন্মত্ততা ছাড়া এ গণবিরোধী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখাও অসম্ভব। লেনিন যেমনটা বলেছিলেন ‘সাম্রাজ্যবাদ মানেই যুদ্ধ’। সাম্রাজ্যবাদ তার নিজস্ব সংকট মোচনের জন্য পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে। 

আজকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী দুই ব্লকের স্বার্থ এবং সুবিধামত সমাপ্তি টানতে পারছে না। তাই এই যুদ্ধ অব্যাহত রেখেই নিজ নিজ অস্ত্রভান্ডার ও যুদ্ধ-মহড়া বৃদ্ধিতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করছে। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনিয়ান দ্বীপে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সদস্যরা যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই দুই দেশের বিমানবাহিনীর এমন মহড়া আগে দেখা যায়নি, যা স্পষ্ট ভাবেই চীনের বিরুদ্ধে হুমকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই তিনিয়ান দ্বীপ থেকেই জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলাকারী মার্কিন যুদ্ধবিমান উড়ে গিয়েছিল। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে শুরু করেছে। এছাড়া যৌথ প্রশিক্ষণ, অস্ত্র উৎপাদন ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে অবকাঠামো তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে দেশগুলো। চীন চাইছে এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দিতে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। চীনকে রুখতে প্রতিবেশী দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। 

গত ১৩ মার্চ উত্তর কোরিয়া সাবমেরিন থেকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়। একই দিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে অস্ট্রেলিয়া ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা করে। জাপান ও ভিয়েতনামের সঙ্গে যৌথ প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে ভারত। দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধবিমান কিনতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া। মার্কিন কর্মকর্তারা চীনের আগ্রাসন রুখতে তাইওয়ানে বিশাল অস্ত্র মজুত করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে বন্দর ও রানওয়ে সুবিধা বাড়াচ্ছে ফিলিপাইন। গতবছরের আগস্টে চীন জাপানের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকার জলসীমায় ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। 

চীনের সামরিক খাতের বার্ষিক ব্যয় এখন ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক সামরিক ব্যয় ৮০ হাজার কোটি টাকা। এ প্রেক্ষিতে অষ্ট্রেলিয়া ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দিচ্ছে। এ অ লে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে মজবুত করতে জাপান ও ভারত একাধিক চুক্তি করেছে। 

এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন কমান্ডাররা আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ বা ২০২৭ সাল নাগাদ যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। চীনের পক্ষ থেকেও যুদ্ধংদেহী মন্তব্য করা হচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিনা গ্যাং এপ্রিল’২৩-এ সতর্ক করে বলেছেন, ওয়াশিংটন যদি ভুল পথে হাঁটতেই থাকে তবে তার দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিশ্বযুদ্ধের অশনিসংকেত সাম্রাজ্যবাদীদের তাড়া করছে।

 গত শতাব্দীতে এমনি বৈশ্বিক সংকটে সংঘটিত প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৃষ্টি হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও চীনের। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক, কৃষকসহ ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের দৃঢ়চেতা সংগ্রাম ও লড়াই-এর কারণেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। 

তাই, সাম্রাজ্যবাদের এ কামড়াকামড়ি ও তার অনুষঙ্গ হিসেবে দেশে দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থানের বিপরীতে জনগণকে শাসকশ্রেণির গণবিরোধী রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যুদ্ধ, তা যদি সীমিত বা সামগ্রিক আকারে বেধেই যায়, তাহলে জনগণকে শুধু পড়ে পড়ে মার খেলে চলবে না। এমনকি উভয় সাম্রাজ্যবাদের কোনো না কোনো পক্ষের খপ্পরে পড়লে চলবে না। জনগণের নিজস্ব সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কর্মসুচির ভিত্তিতে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে সে সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। শোষণ-নিপীড়ন মূলক সাম্রাজ্যবাদী যে বিশ্বব্যবস্থা যুদ্ধের উদগাতা, তাকে সমূলে উৎখাত করার সংগ্রামকে বেগবান করাই হবে জনগণের আশু করণীয়। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে দেশে দেশে সংগঠিত প্রতিরোধকে এক সূত্রে গাঁথতে হবে। জনগণের এই ন্যায়সঙ্গত লড়াইয়ের সফলতাই পৃথিবীকে যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে মুক্তি দিতে পারে। হয় জনগণের যুদ্ধ ও বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী গণহত্যার যুদ্ধকে প্রতিহত করা যাবে, নতুবা যুদ্ধ বেধে গেলে তাকে বিপ্লবী যুদ্ধে পরিণত করে জনগণকে মুক্ত করতে হবে। আজ সারা বিশ্বের জনগণের মতো আমাদের দেশের শ্রমিক, কৃষক, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগণকেও সেজন্য কাজ করতে হবে। যত দ্রুত তত ভালো।  

                                                                   —২৯/৪/’২৩

সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতির বিরুদ্ধে দেশে দেশে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তুলুন

 আন্দোলন প্রতিবেদন 
শুক্রবার, ১২ মে ২০২৩  |  অনলাইন সংস্করণ

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ যুদ্ধ শুধুমাত্র রাশিয়া-ইউক্রেন দু’পক্ষের ভেতরকার কোনো সংঘাত নয়। যুদ্ধ যতই দীর্ঘায়িত হচ্ছে দিনকে দিন তা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পশ্চিমা পরাশক্তি সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের সাথে রুশ সাম্রাজ্যবাদের তীব্র দ্বন্দ্বের প্রতিফলন এ লড়াই। আর এখানে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের দাবার ঘুঁটি হয়েছে ইউক্রেন তথা ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ। এতে সামনে থেকে ক্লাউনের ভূমিকা নিয়েছে পশ্চিমা পাপেট জেলেনস্কি।

যুদ্ধের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে ব্যাপক প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি, অপচয়, বিশেষত: ইউক্রেন জুড়ে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর ঘটনা ঘটছে যার প্রধান শিকার হচ্ছেন নারী-শিশুসহ বৃদ্ধরা। জাতিসংঘের মতে এ পর্যন্ত ৮,০০০ বেসামরিক ইউক্রেনীয় প্রাণ হারিয়েছেন। সারা পৃথিবীর কোথাও কোথাও যখন তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে তখন এক আমেরিকাই ইউক্রেনকে ৮০ বিলিয়ন ডলারের (প্রায় ৯ লক্ষ কোটি টাকা) সামরিকসহ অন্যান্য খাতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সাহায্যের একটা বড় অংশই ইতোমধ্যে ইউক্রেনে পৌঁছেছে। তাদের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী মিত্ররাও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহায়তা করছে জেলেনস্কিকে, যার প্রধান অংশই ব্যয় হচ্ছে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র খাতে। তারা ক্রমবর্ধিত ভাবে আধুনিক সামরিক যান জেলেনস্কি সরকারকে পাঠাচ্ছে। যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদীরা এ যুদ্ধে তাদের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের কার্যকারিতার পরীক্ষা চালাচ্ছে। আর অস্ত্র-শিল্পগুলো লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা লুটছে।

এ যুদ্ধের উত্তাপে শুধু ইউক্রেন নয়, পুড়ছে গোটা দুনিয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন সারা বিশ্বে জ্বালানি ও খাদ্যশস্যের অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হওয়ায় যুদ্ধের ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত, বাণিজ্যিক নানা বিধিনিষেধ ও পরিবহণ/রপ্তানিতে নানান বাধা দরিদ্র দেশগুলোতে তীব্র খাদ্য সংকট সৃষ্টি করেছে। মুদ্রাস্ফীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলস্বরূপ সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির উন্নয়নের মডেল শ্রীলঙ্কা এখনও দেউলিয়াত্ব কাটিয়ে উঠতে পারে নি। পাকিস্তানও সে পথের যাত্রী। আর আফ্রিকার মতো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত গরিব দেশগুলোতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আগাম বার্তা শোনাচ্ছে খোদ জাতিসংঘই। ধনী দেশগুলোতেও মূল্যস্ফীতি সেখানকার সাধারণ বাসিন্দাদের অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নেই। যুদ্ধ-নির্মমতা ছাড়াও রাষ্ট্র-সরকার-লুটেরা ব্যবসায়ীদের সীমাহীন মুনাফার বলি হতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। ইতোমধ্যে শতকরা ৭১ ভাগ জনগণ খাবারের পেছনে অর্থ ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন।

বিশ্বব্যাপী জনগণের এ ভোগান্তির জন্য দায়ী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সাথে সাথে তার অর্থনীতি। গত শতকের ’৯০-এর পর এক মেরু বিশ্বের উদ্ভব হলে পশ্চিমারা বিশ্বায়ন বা গ্লোবাল ভিলেজের যে তত্ত্ব এনেছিল এ তারই কুফল। সাম্রাজ্যবাদী প্রেসক্রিপশনে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মৌলিক শিল্প ক্রমান্বয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়, অনেকটা আমাদের দেশের পাট-চিনি শিল্পের মতো করে। এমনকি আধুনিকায়নের নামে স্ব স্ব দেশের কৃষিটাও করে ফেলা হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি নির্ভর। নিজস্ব স্বাধীন অর্থনীতির বদলে গার্মেন্টস, ট্যুরিজম, অবকাঠামোগত খাতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগ কিংবা প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিটেন্সের মতো সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর শিল্প বা অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে। তৃতীয় বিশ্বের মুৎসুদ্দি শাসক শ্রেণি তাই সাম্রাজ্যবাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বেড়াজালে বন্দি। মূলত সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল শাসকশ্রেণির অর্থনীতির কেন্দ্রে থাকে তাদের মুনাফা-লুটপাট; জনগণের চাহিদা বা দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি সেখানে আদৌ বিবেচ্য নয়। ফলে বাকপটু হাসিনা ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা’র বুলি ঝাড়লেও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই পেড়ে। 

এর ঠিক বিপরীত চিত্র আমরা দেখি গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত দেশে। তখন সারা পৃথিবী অর্থনৈতিক মন্দার বলি হলেও প্রাক্তন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক (বর্তমান রাশিয়া) অর্থনীতির অগ্রগতি তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সমগ্র পুঁজিবাদী বিশ্বকে। সারা বিশ্বের নিপীড়িত, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয়। পুঁজিবাদের  বিপরীতে সমাজতন্ত্র সারা বিশ্বের পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী, লগ্নিকারী, লুটেরাদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়। 

আজ যখন ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদীরা প্রচণ্ড উন্মত্ততায় পৃথিবীকে ভাগ ভাটোয়ারা করতে বিশ্বযুদ্ধের ছক কষছে, তখন পৃথিবীতে কোথাও কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই। যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে এ হেন যুদ্ধ উন্মত্ততা ছাড়া এ গণবিরোধী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখাও অসম্ভব। লেনিন যেমনটা বলেছিলেন ‘সাম্রাজ্যবাদ মানেই যুদ্ধ’। সাম্রাজ্যবাদ তার নিজস্ব সংকট মোচনের জন্য পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে। 

আজকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী দুই ব্লকের স্বার্থ এবং সুবিধামত সমাপ্তি টানতে পারছে না। তাই এই যুদ্ধ অব্যাহত রেখেই নিজ নিজ অস্ত্রভান্ডার ও যুদ্ধ-মহড়া বৃদ্ধিতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করছে। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনিয়ান দ্বীপে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সদস্যরা যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই দুই দেশের বিমানবাহিনীর এমন মহড়া আগে দেখা যায়নি, যা স্পষ্ট ভাবেই চীনের বিরুদ্ধে হুমকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই তিনিয়ান দ্বীপ থেকেই জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলাকারী মার্কিন যুদ্ধবিমান উড়ে গিয়েছিল। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে শুরু করেছে। এছাড়া যৌথ প্রশিক্ষণ, অস্ত্র উৎপাদন ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে অবকাঠামো তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে দেশগুলো। চীন চাইছে এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দিতে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। চীনকে রুখতে প্রতিবেশী দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। 

গত ১৩ মার্চ উত্তর কোরিয়া সাবমেরিন থেকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়। একই দিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে অস্ট্রেলিয়া ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা করে। জাপান ও ভিয়েতনামের সঙ্গে যৌথ প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে ভারত। দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধবিমান কিনতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া। মার্কিন কর্মকর্তারা চীনের আগ্রাসন রুখতে তাইওয়ানে বিশাল অস্ত্র মজুত করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে বন্দর ও রানওয়ে সুবিধা বাড়াচ্ছে ফিলিপাইন। গতবছরের আগস্টে চীন জাপানের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকার জলসীমায় ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। 

চীনের সামরিক খাতের বার্ষিক ব্যয় এখন ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক সামরিক ব্যয় ৮০ হাজার কোটি টাকা। এ প্রেক্ষিতে অষ্ট্রেলিয়া ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দিচ্ছে। এ অ লে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে মজবুত করতে জাপান ও ভারত একাধিক চুক্তি করেছে। 

এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন কমান্ডাররা আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ বা ২০২৭ সাল নাগাদ যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। চীনের পক্ষ থেকেও যুদ্ধংদেহী মন্তব্য করা হচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিনা গ্যাং এপ্রিল’২৩-এ সতর্ক করে বলেছেন, ওয়াশিংটন যদি ভুল পথে হাঁটতেই থাকে তবে তার দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিশ্বযুদ্ধের অশনিসংকেত সাম্রাজ্যবাদীদের তাড়া করছে।

 গত শতাব্দীতে এমনি বৈশ্বিক সংকটে সংঘটিত প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৃষ্টি হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও চীনের। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক, কৃষকসহ ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের দৃঢ়চেতা সংগ্রাম ও লড়াই-এর কারণেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। 

তাই, সাম্রাজ্যবাদের এ কামড়াকামড়ি ও তার অনুষঙ্গ হিসেবে দেশে দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থানের বিপরীতে জনগণকে শাসকশ্রেণির গণবিরোধী রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যুদ্ধ, তা যদি সীমিত বা সামগ্রিক আকারে বেধেই যায়, তাহলে জনগণকে শুধু পড়ে পড়ে মার খেলে চলবে না। এমনকি উভয় সাম্রাজ্যবাদের কোনো না কোনো পক্ষের খপ্পরে পড়লে চলবে না। জনগণের নিজস্ব সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কর্মসুচির ভিত্তিতে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে সে সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। শোষণ-নিপীড়ন মূলক সাম্রাজ্যবাদী যে বিশ্বব্যবস্থা যুদ্ধের উদগাতা, তাকে সমূলে উৎখাত করার সংগ্রামকে বেগবান করাই হবে জনগণের আশু করণীয়। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে দেশে দেশে সংগঠিত প্রতিরোধকে এক সূত্রে গাঁথতে হবে। জনগণের এই ন্যায়সঙ্গত লড়াইয়ের সফলতাই পৃথিবীকে যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে মুক্তি দিতে পারে। হয় জনগণের যুদ্ধ ও বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী গণহত্যার যুদ্ধকে প্রতিহত করা যাবে, নতুবা যুদ্ধ বেধে গেলে তাকে বিপ্লবী যুদ্ধে পরিণত করে জনগণকে মুক্ত করতে হবে। আজ সারা বিশ্বের জনগণের মতো আমাদের দেশের শ্রমিক, কৃষক, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগণকেও সেজন্য কাজ করতে হবে। যত দ্রুত তত ভালো।  

                                                                   —২৯/৪/’২৩

আরও খবর
 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র