নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চার ২য় জাতীয় সম্মেলনে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবাবলি

আন্দোলন প্রতিবেদন
বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | অনলাইন সংস্করণ
আমাদের মোর্চার অঙ্গসংগঠনদ্বয়– বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন ও বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন, এ দুয়ের পক্ষ থেকে সুদীর্ঘদিন ধরে প্রায় নিয়মিতভাবে “আন্দোলন” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তত্ত্বগত কিছু বিষয় (যেমন, মালেমা) ঐ সংগঠনদ্বয়ের নিজস্ব। এগুলো ছাড়া সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী রাজনীতির সকল প্রশ্নেই আমরা সহমত। তাই, উক্ত পত্রিকায় আমাদের অবস্থানও প্রকাশিত হয়। সেকারণে চলমান বিশ্ব ও দেশীয় রাজনীতির প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন পত্রিকাটির মাধ্যমে আমাদের নেতৃত্ব-কেডার ও জনগণের মধ্যে প্রচারিত হচ্ছে।
এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মোর্চার পক্ষ থেকে ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে প্রায় নিয়মিতভাবেই বিভিন্ন বিবৃতিও প্রকাশিত হয়।
তাই, আমরা এখানে বিস্তৃত ও ব্যাখ্যামূলক কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব আনছি না। তার পরিবর্তে চলমান গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয়/ইস্যুগুলোতে আমাদের মৌলিক অবস্থান ব্যক্ত করে নিচের সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবগুলো পেশ করা হচ্ছে।
দেশীয়
১। হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদ
হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদ স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা জনগণের উপর বর্বর নিপীড়নেই শুধু নিজেকে প্রকাশ করে না। তার রয়েছে একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক-মতাদর্শ, যা বিগত ১৫ বছর ধরে প্রধানত ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের মদদে ও সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনে ক্ষমতাসীন হয়ে রয়েছে। এবং এমনকি বুর্জোয়া বিরোধীদের উপরও বর্বর দমননীতি চালিয়ে বুর্জোয়া নির্বাচন-ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে বুর্জোয়া বিরোধীরাও তার বিরুদ্ধে তার উচ্ছেদের বহুরকম আন্দোলনে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
কিন্তু বুর্জোয়া বিরোধী দলগুলো এজন্য আশ্রয় নিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে। আর তাদের কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার এ ব্যবস্থার অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। বিপরীতে জনগণের জন্য প্রয়োজন হলো সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী অবস্থান থেকে জনগণের লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদ করে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের একটি “গণ-সরকার” প্রতিষ্ঠা করা।
এই বিপ্লবী রণকৌশলকে সামনে রেখে ফ্যাসিবাদ বিরোধী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আমরা ব্যাপক জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি।
আওয়াজ তুলুন, হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদ অবসান এবং “শ্রমিক-কৃষক-জনগণের বিপ্লবী গণ-সরকার” প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলুন, শক্তিশালী করুন!
২। নতুন মোড়কে ডিজিটাল আইন
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বহু স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে ডিজিটাল আইন অন্যতম। যার মাধ্যমে জনগণের মত প্রকাশের অধিকার সম্পূর্ণভাবে সংকুচিত করা হয়েছে। তথাকথিত ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিট্যালি হাসিনা-আওয়ামী বিরোধী মত প্রকাশের ‘অপরাধে’ অসংখ্য মামলা ও হয়রানি চলছে। এই আইন, পূর্বের বিবিধ কালাকানুনের সহযোগে হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে নিজ কুক্ষিগত ক্ষমতা রক্ষায় সক্ষম করে তুলেছে। জনমত ও সাম্রাজ্যবাদীদের চাপে সরকার সম্প্রতি শঠতার সাথে ডিজিটাল আইন বাতিল করে এবং দু’একটি সংশোধনী দিয়ে একইরকম নতুন সাইবার আইন প্রণয়ন করেছে। এটা একটি বদমাইশি প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।
নতুন মোড়কে এই ফ্যাসিবাদী ডিজিটাল আইন (সাইবার আইন)সহ সকল কালাকানুন অবিলম্বে প্রত্যাহার করা, গ্রেফতারকৃত সকল বন্দিকে মুক্তি দেয়া, সকল মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে ক্ষতিপূরণ দানের জোর দাবি আমরা উত্থাপন করছি।
৩। জাতীয় নির্বাচন
আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরস্থ দ্বন্দ্ব তীব্র রূপ ধারণ করেছে, যা বিরোধী বুর্জোয়া দলগুলোর “তত্ত্বাবধায়ক” আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে।
এই দ্বন্দ্বে গুরুতর ভূমিকা ও প্রভাব রাখছে তীব্র হয়ে ওঠা আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব এবং মার্কিনের নেতৃত্বাধীন একমেরু বিশ্বের জায়গায় একদিকে মার্কিন-ইইউ, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া– এ দু’পক্ষের নেতৃত্বে দ্বি-মেরু বিশ্ব।
আমাদের দেশে এক্ষেত্রে আরো বিশেষ ভূমিকা রাখছে আ লিক পরা-শক্তি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ।
জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে এ পরিস্থিতিতে আমাদের এ সম্মেলন ব্যাপক শ্রমিক, কৃষক, দরিদ্র, শ্রমজীবী, নারী, ছাত্র, জাতিগত সংখ্যালঘুসহ ব্যাপক জনগণকে বিপ্লবী রাজনীতিতে সচেতন হবার আহ্বান জানাচ্ছে। বুর্জোয়া রাজনীতি বর্জনের আহ্বান জানাচ্ছে। বুর্জোয়া লেজুড় তথাকথিত বাম রাজনীতি উন্মোচনের আহ্বান জানাচ্ছে।
৪। শ্রমিকের মজুরি ও তথাকথিত পরিষেবা আইন
গার্মেন্ট, চা-শিল্প, নৌ-পরিবহনসহ বিবিধ শিল্প-সেক্টরে শ্রমিক শ্রেণি তাদের মজুরি বৃদ্ধি, বকেয়া বেতন পরিশোধের জন্য যে আন্দোলন করেছেন ও করে চলেছেন, এ সম্মেলন সেগুলোর সাথে দৃঢ় সংহতি ঘোষণা করছে। আমরা সকল শ্রমক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য সুস্থ ও সম্মানজনক জীবনযাপনের উপযোগী নিম্নতম মজুরির আন্দোলনকে অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।
একইসাথে শ্রমিক আন্দোলন দমনের জন্য হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার যে তথাকথিত “পরিষেবা আইন” করেছে তা অবিলম্বে প্রত্যাহার ও সেজন্য আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।
বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।
৫। রিক্সা-অটো-হকার-ক্ষুদে ব্যবসায়ী উচ্ছেদ
রিক্সা-অটো-হকার-ক্ষুদে ব্যবসায়ী উচ্ছেদের জন্য রাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে কিছুদিন পরপরই অভিযান চালাচ্ছে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও দরিদ্র জনগণ নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পতিত হচ্ছেন।
আমরা এই হীন দরিদ্র-বিরোধী তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি।
৬। কৃষি ও কৃষক বাঁচাও
ক’দিন পরপরই সার, জ্বালানি তেল, বিদ্যুতসহ বিবিধ কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষি ও কৃষক হুমকির মুখে পড়েছে।
আমরা বড় বুর্জোয়াদের স্বার্থে গৃহীত এ নীতি অবিলম্বে বাতিল করা এবং তার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের কৃষক জনগণকে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।
কৃষক ফসল তোলার পর বাজার সিন্ডিকেটের কারণে তার ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। বাজার সিন্ডিকেট ও ফড়িয়া-আড়তদারী নিয়ন্ত্রণকে ভেঙ্গে দিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ন্যায্য মূল্যে কৃষি-পণ্য কেনার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।
কৃষকের উপর সুদ, দাদন, এনজিও ঋণের বোঝার কারণে কৃষক হতাশাগ্রস্থ হয়ে জায়গায় জায়গায় আত্মহত্যার আশ্রয় নিতে পর্যন্ত বাধ্য হচ্ছেন। এ ধরনের সুদি কারবার থেকে কৃষকের মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।
কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য আইএমএফ-সহ সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো যে ঋণ-শর্ত দিয়েছে ও সরকার তার কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ করেছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং এ ধরনের শর্তযুক্ত ঋণ-চুক্তি বাতিলের জোর দাবি জানাচ্ছি।
৭। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস
ফ্যাসিবাদী সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠা ছাত্রলীগের নির্যাতন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে এতোটাই বেড়ে গেছে যে, সেখানে আত্মহত্যা ও হত্যার ঘটনাও ঘটে চলেছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরার হত্যা এরই একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া সিট-বাণিজ্য, গেস্টরুম, টেন্ডার বাণিজ্য, ছাত্রলীগ মিছিলে যেতে বাধ্য করা হরদম চলছে। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নিয়মিতভাবে শারীরিক নিপীড়ন, এমনকি যৌন-নির্যাতন পর্যন্ত তারা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা কলেজ-ভার্সিটি ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ মুক্ত করার জন্য সাধারণ ছাত্রদেরকে উদাত্ত আহ্বান জানাই।
৮। পাঠ্য-পুস্তক ও শিক্ষা-কার্যক্রমে বিজ্ঞানকে নির্বাসিত করণ
৬ষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুসারে মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস খুবই দুর্বলভাবে তুলে ধরা সত্ত্বেও ধর্মবাদীদের তর্জন-গর্জনে সরকার সেই সব বই প্রত্যাহার করে তাদের কাছে নির্লজ্জ নতি স্বীকার করেছে। এবং তারা আরো এগিয়ে ধর্মশিক্ষাকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করেছে। এছাড়া ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞান পরিচয়ের ক্ষেত্রে এই বইগুলোতে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী ভাবধারায় সজ্জিত বিকৃত/খন্ডিত ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং সম্পূর্ণ বিজ্ঞান-ভিত্তিক ও ধর্ম-বিযুক্ত শিক্ষার জন্য ছাত্র-সমাজকে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।
৯। দ্রব্যমূল্য
কখনো পিয়াজের দাম ১০০/২০০ টাকা, কখনো বা কাঁচামরিচের দাম ৬০০ টাকা। আদা, রসুন, চাল, আটা, মাছ, ভোজ্য তেল, চিনিÑ ইত্যাদি প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বি। সেইসাথে বাড়ছে বাসা-ভাড়া। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধির কারণে জনজীবন ওষ্ঠাগত।
এই মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ শাসকশ্রেণির দুনর্ীতি ও লাগামহীন শোষণ, বিশেষত আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের লুটপাট, বিদেশে অর্থ-পাচার ও সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের শোষণ।
এই লুটেরা ও দেশদ্রোহী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলন-সংগ্রাম ব্যতীত জনগণের সামনে আর কোনো পথ নেই। আমরা, এ সম্মেলন, জনগণের প্রতি সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানাই।
১০। করোনা, ডেঙ্গু, মশা.......
সরকারের গলাবাজী সত্ত্বেও করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা তাদের মিথ্যা দাবি মতেই ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন ঘরে ঘরে চলছে ডেঙ্গুর আক্রমণ। অথচ নগরেও মশা নিধনের সত্যিকার কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা নেই।
এই ব্যবস্থাধীনে জনজীবনের এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় দেখা যায় না। দুনর্ীতি ও জনজীবনের প্রতি ক্ষমাহীন উদাসীনতায় এ ধরনের রোগ ও মহামারিতে জনগণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
জরুরি পদক্ষেপের মাধ্যমে মশা নির্মূল ও ডেঙ্গু রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা করার জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।
১১। পাহাড়ি ও আদিবাসী জনগণের সমস্যা
পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী নিপীড়নের মাঝে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের মাঝে অব্যাহত ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে এক নারকীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও মিয়ানমারের স্বৈরাচারি সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও পাহাড়ী জনগণের বিভিন্ন সংগঠনের ভুল নীতি একে বাড়িয়ে তুলেছে।
আমরা অবিলম্বে পাহাড়ি জনগণকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ করে পাহাড়ী-বাঙালি নিপীড়িত জনগণের ঐক্য গড়ে তুলে তাদের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।
দেশের অন্য সব এলাকায় ছড়িয়ে থাকা আদিবাসী জনগণের ভূমির লড়াই, ভাষার লড়াই, ইজ্জতের লড়াইকে আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি এবং তাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি বৃহত্তর জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের সাথে নিজেদের যুক্ত করতে।
১২। ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের উপর নিপীড়ন
হিন্দু, বৌদ্ধসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের উপর অতীতের সকল সরকারের মতো একইভাবে হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদীরাও আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদের অজুহাতে তাদের জমি দখল, দেশত্যাগে বাধ্য করা, নারীদের উপর নির্যাতন, ঘর-বাড়ি-উপাসনালয়ে আগুন লাগানো– ইত্যাদি অব্যাহত রয়েছে। ধর্মবাদকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নকেও বাড়িয়ে তোলার ভিত্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে।
আমরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণকে আহ্বান জানাই, বুর্জোয়া দল ও রাজনীতির ছেলেভুলানো কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে তাদের সমগ্র গোষ্ঠীকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করুন এবং বিপ্লবী রাজনীতিতে সজ্জিত হয়ে নতুন এক সহনশীল ও ভ্রাতৃমূলক সম্পর্কের সমাজ নির্মাণে এগিয়ে আসুন।
১৩। নারী নিপীড়ন
নারী-নিপীড়ন সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ভার্সিটিতে, পরিবহণে, থানায়, পরিবারে, মাদ্রাসায়, ক্যান্টনমেন্টে, পথে-ঘাটে– সর্বত্র নারীরা এই দেশে এখন অনিরাপদ। স্বামী, শ্বশুররা তাদেরকে হত্যা করছে যৌতুকের জন্য। সন্ত্রাসীরা হত্যা করছে জোর করে বিয়ে করা বা ধর্ষণ করার জন্য। শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউ ধর্ষণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।
ক্ষমতাসীনরা এগুলোর পরিবেশ তৈরি করেছে, তারা এসবে সক্রিয় এবং মদদ দিচ্ছে। ফলে এসবের কোনো ন্যায্য বিচার প্রায়ই নিপীড়তরা পাচ্ছেন না।
এই ভয়াবহ সমাজ ও পরিস্থিতি থেকে নারীদের মুক্ত হতে হলে এই সমাজকে বদলে ফেলার সংগ্রামে তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই আহ্বান আমরা নারী জাতির প্রতি রাখছি।
১৪। জনগণের বহুবিধ আন্দোলন
বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী শাসন ও মুৎসুদ্দি-সামন্ত-সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের জনগণ তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে বহুবিধ আন্দোলন প্রতিনিয়ত গড়ে তুলছেন। তার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ হলো– গার্মেন্ট-শ্রমিক, চা-শ্রমিক, নৌ-পরিবহণ শ্রমিক আন্দোলন, জমি রক্ষার জন্য কৃষকদের আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের জন্য ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের জন্য ছাত্র-আন্দোলন, ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলন, আদিবাসী জনগণের আন্দোলন, রামপাল-বিরোধী আন্দোলন, সন্ত্রাসী ডিজিটাল আইন বিরোধী আন্দোলনসহ বহুবিধ আন্দোলন।
এমপিও-ভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনকে আমরা দৃঢ় সমর্থন জানাই। দৃঢ় আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে নতিস্বীকারে বাধ্য করায় শিক্ষকসমাজকে আমরা অভিনন্দিত করছি। একইসাথে তাদের বেতনবৃদ্ধির আড়ালে মূল দাবি– জাতীয়করণ, তাকে আড়াল করার সরকারি ষড়যন্ত্রকে আমরা নিন্দা জানাচ্ছি। শিক্ষা ক্ষেত্রে সকল প্রকার বৈষম্য সৃষ্টির নীতিকে আমরা নিন্দা জানাচ্ছি এবং মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাকে জাতীয়করণ ও একধারার শিক্ষা চালুর জোর দাবি জানাচ্ছি।
আমরা জনগণের এ সমস্ত আন্দোলনকে উচ্ছ্বসিত সমর্থন জানাচ্ছি। একইসাথে আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানাই বিপ্লবী রাজনীতিতে সজ্জিত হয়ে তার আলোকে সমাজ-বিপ্লবের পথে এগিয়ে আসার জন্য। কেননা, বিপ্লবী সমাজ প্রতিষ্ঠা না হলে এ ধরনের আন্দোলন রাষ্ট্রীয়-দলীয় দমনের মুখে বা কিছু সংস্কার করে পথ হারিয়ে ফেলে। এবং প্রায় ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি কার্যত একই থেকে যায়।
১৫। রোহিঙ্গা সমস্যা
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে সরকারের দুর্বলতা হলো চীন, রাশিয়া ও ভারত রাষ্ট্রকে বলিষ্ঠ বিরোধিতা করায় তার ব্যর্থতা। এ কারণেই তারা মিয়ানমার সামরিক জান্তার সাথে আপসমুখী নীতি নিচ্ছে। অন্যদিকে মার্কিন ও পশ্চিমা সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতার কারণে তাদের সাথেও আপস করছে।
রোহিঙ্গা জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মূল সমস্যাকে তারা আড়াল করছে। একইসাথে ঐ অ লে ও দেশজুড়ে রোহিঙ্গা জনগণের বিরোধী উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী অপচেতনাকেও পানি দিচ্ছে।
এসবের ফলে রোহিঙ্গা জনগণ এক মানবেতর ও অনিশ্চিত জীবনে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন।
আমরা রোহিঙ্গা জনগণকে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল সরকারগুলোর ভিক্ষার উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেদের মুক্তির জন্য বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরছি।
আন্তর্জাতিক
১। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব ও ইউক্রেন যুদ্ধ
সামাম্রাজ্যবাদীদের বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি গুরুতর আকার ধারণ করেছে। যার অনিবার্য প্রকাশ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মোড়লীপনার একমেরু বিশ্ব ভেঙ্গে পড়েছে।
এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়া, আরো তীব্র হওয়া ও বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা কিনা একটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে এবং সার্বিক বা সীমিত পারমাণবিক যুদ্ধের দিকেও বিশ্বকে চালিত করতে পারে।
এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাই, বিশ্ব জনগণের সাথে আমাদেরকেও এই যুদ্ধ-চক্রান্তের বিরোধিতা করতে হবে এবং যুদ্ধ-বিস্তারের পক্ষে যেকোনো ধরনের সাম্রাজ্যবাদী বা তাদের দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি শাসকশ্রেণির পদক্ষেপকে উন্মোচন করতে হবে। আমাদেরকে বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধ-প্রস্তুতিকে ভণ্ডুল করে দিতে হবে। আর যদিই বা যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে তাকে বিপ্লবী যুদ্ধে পরিণত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
২। বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের সংগ্রাম
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব-ব্যবস্থা, তার বিভিন্ন পলিসি ও যুদ্ধ-চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিশ্বের বহু দেশে জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চলছে। তার মাঝে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারত ও ফিলিপাইনের জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম। এছাড়া কিছু সময় আগে ভারতের কৃষকদের এক দীর্ঘস্থায়ী গণসংগ্রাম, আমেরিকায় কালো জনগণের উপর নিপীড়ন বিরোধী সংগ্রাম, সম্প্রতি ফ্রান্সের জনগণের সংগ্রাম সারা দুনিয়ার জনগণের দৃষ্টি কেড়েছে।
আমরা এ ধরনের বিপ্লবী ও প্রগতিশীল সংগ্রামকে উচ্ছ্বসিত সমর্থন জানাই ও এ সম্মেলন থেকে তাদেরকে মোবারকবাদ জানাই।
৩। বিশ্বের নিপীড়িত জাতিসমূহের সংগ্রাম
ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, কুর্দিস্থান, উত্তর-পূর্ব ভারতের জাতিসত্তাসহ বিশ্বের দেশে দেশে নিপীড়িত জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রামকে এ সম্মেলন থেকে আমরা উষ্ণ সমর্থন জানাই।
৪। ভারতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিকাশ
এ সম্মেলন উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি, মোদি ও তার সহযোগীদের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের দৌরাত্ম দিন দিন বেড়ে চলেছে। মুসলিম জনগণের উপর বিবিধ নিপীড়ন জারী রয়েছে ও বাড়ছে। তাদেরই মদদে মনিপুর রাজ্যে এক ভ্রাতৃঘাতী জাতিগত সংঘাতে বহু মানুষ নিহত-আহত হয়েছেন ও হচ্ছেন। এসবের বিরুদ্ধে ভারতের বিপ্লবী, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তি সাহসী সংগ্রাম পরিচালনা করছেন। আমরা এই ক্রমবর্ধিত হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদকে নিন্দা জানাই এবং তার বিরুদ্ধে ভারতের জনগণের সংগ্রামকে সালাম জানাই।
৫। ইরান-আফগানিস্তানে নারীর বিরুদ্ধে ধর্মবাদী জেহাদ
ইরানে মাসা আমিনির হত্যার সূত্র ধরে সেখানকার ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে প্রধানত বিপুল নারীসহ ব্যাপক জনগণের যে বিশ্ব কাঁপানো সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল তাকে এ সম্মেলন থেকে আমরা উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন জানাই।
একইসাথে আমরা আফগানিস্তানে ধর্মবাদীদের দ্বারা নারীর বিরুদ্ধে জারি করা বিবিধ মধ্যযুগীয় নিপীড়ন ও দমনকে নিন্দা জানাই।
এসবের সূত্র ধরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা এসব দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তকেও আমরা নিন্দা জানাই। ইরান-আফগানিস্তানের নিপীড়িত নারী ও জনগণকে আমরা বিপ্লবী রাজনীতির আলোকে সজ্জিত হওয়া ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে আগুয়ান হবার আহ্বান জানাচ্ছি।
৬। ইউরোপীয় কিছু দেশে কোরআন পোড়ানো
সম্প্রতি ডেনমার্ক ও সুইডেনসহ কিছু দেশে কোরআন পোড়ানোর মাধ্যমে ইসলামোফোবিয়াকে উস্কে দেয়া হচ্ছে। যার পরিণতি হলো, ধর্মের ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি, সাম্রাজ্যবাদের মূল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়ে তাকে রক্ষা করা এবং একইসাথে মুসলিম মৌলবাদী ফ্যাসিবাদকে শক্তিশালী হতে শর্ত জোগানো।
আমরা এ ধরনের নৈরাজ্যকর ও চক্রান্তমূলক অপতৎপরতাকে নিন্দা জানাই এবং মত প্রকাশের নামে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ঘোষণাকে বিরোধিতা করি। একইসাথে এর সুযোগ নিয়ে মুসলিম ধর্মবাদীদের মধ্যযুগীয় তৎপরতারও নিন্দা জানাই।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চার ২য় জাতীয় সম্মেলনে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবাবলি
আমাদের মোর্চার অঙ্গসংগঠনদ্বয়– বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন ও বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন, এ দুয়ের পক্ষ থেকে সুদীর্ঘদিন ধরে প্রায় নিয়মিতভাবে “আন্দোলন” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তত্ত্বগত কিছু বিষয় (যেমন, মালেমা) ঐ সংগঠনদ্বয়ের নিজস্ব। এগুলো ছাড়া সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী রাজনীতির সকল প্রশ্নেই আমরা সহমত। তাই, উক্ত পত্রিকায় আমাদের অবস্থানও প্রকাশিত হয়। সেকারণে চলমান বিশ্ব ও দেশীয় রাজনীতির প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন পত্রিকাটির মাধ্যমে আমাদের নেতৃত্ব-কেডার ও জনগণের মধ্যে প্রচারিত হচ্ছে।
এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মোর্চার পক্ষ থেকে ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে প্রায় নিয়মিতভাবেই বিভিন্ন বিবৃতিও প্রকাশিত হয়।
তাই, আমরা এখানে বিস্তৃত ও ব্যাখ্যামূলক কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব আনছি না। তার পরিবর্তে চলমান গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয়/ইস্যুগুলোতে আমাদের মৌলিক অবস্থান ব্যক্ত করে নিচের সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবগুলো পেশ করা হচ্ছে।
দেশীয়
১। হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদ
হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদ স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা জনগণের উপর বর্বর নিপীড়নেই শুধু নিজেকে প্রকাশ করে না। তার রয়েছে একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক-মতাদর্শ, যা বিগত ১৫ বছর ধরে প্রধানত ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের মদদে ও সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনে ক্ষমতাসীন হয়ে রয়েছে। এবং এমনকি বুর্জোয়া বিরোধীদের উপরও বর্বর দমননীতি চালিয়ে বুর্জোয়া নির্বাচন-ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে বুর্জোয়া বিরোধীরাও তার বিরুদ্ধে তার উচ্ছেদের বহুরকম আন্দোলনে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
কিন্তু বুর্জোয়া বিরোধী দলগুলো এজন্য আশ্রয় নিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে। আর তাদের কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার এ ব্যবস্থার অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। বিপরীতে জনগণের জন্য প্রয়োজন হলো সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী অবস্থান থেকে জনগণের লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদ করে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের একটি “গণ-সরকার” প্রতিষ্ঠা করা।
এই বিপ্লবী রণকৌশলকে সামনে রেখে ফ্যাসিবাদ বিরোধী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আমরা ব্যাপক জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি।
আওয়াজ তুলুন, হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদ অবসান এবং “শ্রমিক-কৃষক-জনগণের বিপ্লবী গণ-সরকার” প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলুন, শক্তিশালী করুন!
২। নতুন মোড়কে ডিজিটাল আইন
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বহু স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে ডিজিটাল আইন অন্যতম। যার মাধ্যমে জনগণের মত প্রকাশের অধিকার সম্পূর্ণভাবে সংকুচিত করা হয়েছে। তথাকথিত ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিট্যালি হাসিনা-আওয়ামী বিরোধী মত প্রকাশের ‘অপরাধে’ অসংখ্য মামলা ও হয়রানি চলছে। এই আইন, পূর্বের বিবিধ কালাকানুনের সহযোগে হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে নিজ কুক্ষিগত ক্ষমতা রক্ষায় সক্ষম করে তুলেছে। জনমত ও সাম্রাজ্যবাদীদের চাপে সরকার সম্প্রতি শঠতার সাথে ডিজিটাল আইন বাতিল করে এবং দু’একটি সংশোধনী দিয়ে একইরকম নতুন সাইবার আইন প্রণয়ন করেছে। এটা একটি বদমাইশি প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।
নতুন মোড়কে এই ফ্যাসিবাদী ডিজিটাল আইন (সাইবার আইন)সহ সকল কালাকানুন অবিলম্বে প্রত্যাহার করা, গ্রেফতারকৃত সকল বন্দিকে মুক্তি দেয়া, সকল মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে ক্ষতিপূরণ দানের জোর দাবি আমরা উত্থাপন করছি।
৩। জাতীয় নির্বাচন
আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরস্থ দ্বন্দ্ব তীব্র রূপ ধারণ করেছে, যা বিরোধী বুর্জোয়া দলগুলোর “তত্ত্বাবধায়ক” আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে।
এই দ্বন্দ্বে গুরুতর ভূমিকা ও প্রভাব রাখছে তীব্র হয়ে ওঠা আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব এবং মার্কিনের নেতৃত্বাধীন একমেরু বিশ্বের জায়গায় একদিকে মার্কিন-ইইউ, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া– এ দু’পক্ষের নেতৃত্বে দ্বি-মেরু বিশ্ব।
আমাদের দেশে এক্ষেত্রে আরো বিশেষ ভূমিকা রাখছে আ লিক পরা-শক্তি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ।
জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে এ পরিস্থিতিতে আমাদের এ সম্মেলন ব্যাপক শ্রমিক, কৃষক, দরিদ্র, শ্রমজীবী, নারী, ছাত্র, জাতিগত সংখ্যালঘুসহ ব্যাপক জনগণকে বিপ্লবী রাজনীতিতে সচেতন হবার আহ্বান জানাচ্ছে। বুর্জোয়া রাজনীতি বর্জনের আহ্বান জানাচ্ছে। বুর্জোয়া লেজুড় তথাকথিত বাম রাজনীতি উন্মোচনের আহ্বান জানাচ্ছে।
৪। শ্রমিকের মজুরি ও তথাকথিত পরিষেবা আইন
গার্মেন্ট, চা-শিল্প, নৌ-পরিবহনসহ বিবিধ শিল্প-সেক্টরে শ্রমিক শ্রেণি তাদের মজুরি বৃদ্ধি, বকেয়া বেতন পরিশোধের জন্য যে আন্দোলন করেছেন ও করে চলেছেন, এ সম্মেলন সেগুলোর সাথে দৃঢ় সংহতি ঘোষণা করছে। আমরা সকল শ্রমক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য সুস্থ ও সম্মানজনক জীবনযাপনের উপযোগী নিম্নতম মজুরির আন্দোলনকে অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।
একইসাথে শ্রমিক আন্দোলন দমনের জন্য হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার যে তথাকথিত “পরিষেবা আইন” করেছে তা অবিলম্বে প্রত্যাহার ও সেজন্য আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।
বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।
৫। রিক্সা-অটো-হকার-ক্ষুদে ব্যবসায়ী উচ্ছেদ
রিক্সা-অটো-হকার-ক্ষুদে ব্যবসায়ী উচ্ছেদের জন্য রাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে কিছুদিন পরপরই অভিযান চালাচ্ছে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও দরিদ্র জনগণ নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পতিত হচ্ছেন।
আমরা এই হীন দরিদ্র-বিরোধী তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি।
৬। কৃষি ও কৃষক বাঁচাও
ক’দিন পরপরই সার, জ্বালানি তেল, বিদ্যুতসহ বিবিধ কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষি ও কৃষক হুমকির মুখে পড়েছে।
আমরা বড় বুর্জোয়াদের স্বার্থে গৃহীত এ নীতি অবিলম্বে বাতিল করা এবং তার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের কৃষক জনগণকে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।
কৃষক ফসল তোলার পর বাজার সিন্ডিকেটের কারণে তার ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। বাজার সিন্ডিকেট ও ফড়িয়া-আড়তদারী নিয়ন্ত্রণকে ভেঙ্গে দিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ন্যায্য মূল্যে কৃষি-পণ্য কেনার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।
কৃষকের উপর সুদ, দাদন, এনজিও ঋণের বোঝার কারণে কৃষক হতাশাগ্রস্থ হয়ে জায়গায় জায়গায় আত্মহত্যার আশ্রয় নিতে পর্যন্ত বাধ্য হচ্ছেন। এ ধরনের সুদি কারবার থেকে কৃষকের মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।
কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য আইএমএফ-সহ সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো যে ঋণ-শর্ত দিয়েছে ও সরকার তার কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ করেছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং এ ধরনের শর্তযুক্ত ঋণ-চুক্তি বাতিলের জোর দাবি জানাচ্ছি।
৭। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস
ফ্যাসিবাদী সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠা ছাত্রলীগের নির্যাতন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে এতোটাই বেড়ে গেছে যে, সেখানে আত্মহত্যা ও হত্যার ঘটনাও ঘটে চলেছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরার হত্যা এরই একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া সিট-বাণিজ্য, গেস্টরুম, টেন্ডার বাণিজ্য, ছাত্রলীগ মিছিলে যেতে বাধ্য করা হরদম চলছে। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নিয়মিতভাবে শারীরিক নিপীড়ন, এমনকি যৌন-নির্যাতন পর্যন্ত তারা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা কলেজ-ভার্সিটি ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ মুক্ত করার জন্য সাধারণ ছাত্রদেরকে উদাত্ত আহ্বান জানাই।
৮। পাঠ্য-পুস্তক ও শিক্ষা-কার্যক্রমে বিজ্ঞানকে নির্বাসিত করণ
৬ষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুসারে মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস খুবই দুর্বলভাবে তুলে ধরা সত্ত্বেও ধর্মবাদীদের তর্জন-গর্জনে সরকার সেই সব বই প্রত্যাহার করে তাদের কাছে নির্লজ্জ নতি স্বীকার করেছে। এবং তারা আরো এগিয়ে ধর্মশিক্ষাকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করেছে। এছাড়া ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞান পরিচয়ের ক্ষেত্রে এই বইগুলোতে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী ভাবধারায় সজ্জিত বিকৃত/খন্ডিত ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং সম্পূর্ণ বিজ্ঞান-ভিত্তিক ও ধর্ম-বিযুক্ত শিক্ষার জন্য ছাত্র-সমাজকে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।
৯। দ্রব্যমূল্য
কখনো পিয়াজের দাম ১০০/২০০ টাকা, কখনো বা কাঁচামরিচের দাম ৬০০ টাকা। আদা, রসুন, চাল, আটা, মাছ, ভোজ্য তেল, চিনিÑ ইত্যাদি প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বি। সেইসাথে বাড়ছে বাসা-ভাড়া। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধির কারণে জনজীবন ওষ্ঠাগত।
এই মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ শাসকশ্রেণির দুনর্ীতি ও লাগামহীন শোষণ, বিশেষত আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের লুটপাট, বিদেশে অর্থ-পাচার ও সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের শোষণ।
এই লুটেরা ও দেশদ্রোহী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলন-সংগ্রাম ব্যতীত জনগণের সামনে আর কোনো পথ নেই। আমরা, এ সম্মেলন, জনগণের প্রতি সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানাই।
১০। করোনা, ডেঙ্গু, মশা.......
সরকারের গলাবাজী সত্ত্বেও করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা তাদের মিথ্যা দাবি মতেই ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন ঘরে ঘরে চলছে ডেঙ্গুর আক্রমণ। অথচ নগরেও মশা নিধনের সত্যিকার কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা নেই।
এই ব্যবস্থাধীনে জনজীবনের এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় দেখা যায় না। দুনর্ীতি ও জনজীবনের প্রতি ক্ষমাহীন উদাসীনতায় এ ধরনের রোগ ও মহামারিতে জনগণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
জরুরি পদক্ষেপের মাধ্যমে মশা নির্মূল ও ডেঙ্গু রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা করার জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।
১১। পাহাড়ি ও আদিবাসী জনগণের সমস্যা
পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী নিপীড়নের মাঝে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের মাঝে অব্যাহত ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে এক নারকীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও মিয়ানমারের স্বৈরাচারি সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও পাহাড়ী জনগণের বিভিন্ন সংগঠনের ভুল নীতি একে বাড়িয়ে তুলেছে।
আমরা অবিলম্বে পাহাড়ি জনগণকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ করে পাহাড়ী-বাঙালি নিপীড়িত জনগণের ঐক্য গড়ে তুলে তাদের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।
দেশের অন্য সব এলাকায় ছড়িয়ে থাকা আদিবাসী জনগণের ভূমির লড়াই, ভাষার লড়াই, ইজ্জতের লড়াইকে আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি এবং তাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি বৃহত্তর জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের সাথে নিজেদের যুক্ত করতে।
১২। ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের উপর নিপীড়ন
হিন্দু, বৌদ্ধসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের উপর অতীতের সকল সরকারের মতো একইভাবে হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদীরাও আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদের অজুহাতে তাদের জমি দখল, দেশত্যাগে বাধ্য করা, নারীদের উপর নির্যাতন, ঘর-বাড়ি-উপাসনালয়ে আগুন লাগানো– ইত্যাদি অব্যাহত রয়েছে। ধর্মবাদকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নকেও বাড়িয়ে তোলার ভিত্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে।
আমরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণকে আহ্বান জানাই, বুর্জোয়া দল ও রাজনীতির ছেলেভুলানো কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে তাদের সমগ্র গোষ্ঠীকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করুন এবং বিপ্লবী রাজনীতিতে সজ্জিত হয়ে নতুন এক সহনশীল ও ভ্রাতৃমূলক সম্পর্কের সমাজ নির্মাণে এগিয়ে আসুন।
১৩। নারী নিপীড়ন
নারী-নিপীড়ন সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ভার্সিটিতে, পরিবহণে, থানায়, পরিবারে, মাদ্রাসায়, ক্যান্টনমেন্টে, পথে-ঘাটে– সর্বত্র নারীরা এই দেশে এখন অনিরাপদ। স্বামী, শ্বশুররা তাদেরকে হত্যা করছে যৌতুকের জন্য। সন্ত্রাসীরা হত্যা করছে জোর করে বিয়ে করা বা ধর্ষণ করার জন্য। শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউ ধর্ষণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।
ক্ষমতাসীনরা এগুলোর পরিবেশ তৈরি করেছে, তারা এসবে সক্রিয় এবং মদদ দিচ্ছে। ফলে এসবের কোনো ন্যায্য বিচার প্রায়ই নিপীড়তরা পাচ্ছেন না।
এই ভয়াবহ সমাজ ও পরিস্থিতি থেকে নারীদের মুক্ত হতে হলে এই সমাজকে বদলে ফেলার সংগ্রামে তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই আহ্বান আমরা নারী জাতির প্রতি রাখছি।
১৪। জনগণের বহুবিধ আন্দোলন
বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী শাসন ও মুৎসুদ্দি-সামন্ত-সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের জনগণ তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে বহুবিধ আন্দোলন প্রতিনিয়ত গড়ে তুলছেন। তার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ হলো– গার্মেন্ট-শ্রমিক, চা-শ্রমিক, নৌ-পরিবহণ শ্রমিক আন্দোলন, জমি রক্ষার জন্য কৃষকদের আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের জন্য ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের জন্য ছাত্র-আন্দোলন, ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলন, আদিবাসী জনগণের আন্দোলন, রামপাল-বিরোধী আন্দোলন, সন্ত্রাসী ডিজিটাল আইন বিরোধী আন্দোলনসহ বহুবিধ আন্দোলন।
এমপিও-ভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনকে আমরা দৃঢ় সমর্থন জানাই। দৃঢ় আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে নতিস্বীকারে বাধ্য করায় শিক্ষকসমাজকে আমরা অভিনন্দিত করছি। একইসাথে তাদের বেতনবৃদ্ধির আড়ালে মূল দাবি– জাতীয়করণ, তাকে আড়াল করার সরকারি ষড়যন্ত্রকে আমরা নিন্দা জানাচ্ছি। শিক্ষা ক্ষেত্রে সকল প্রকার বৈষম্য সৃষ্টির নীতিকে আমরা নিন্দা জানাচ্ছি এবং মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাকে জাতীয়করণ ও একধারার শিক্ষা চালুর জোর দাবি জানাচ্ছি।
আমরা জনগণের এ সমস্ত আন্দোলনকে উচ্ছ্বসিত সমর্থন জানাচ্ছি। একইসাথে আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানাই বিপ্লবী রাজনীতিতে সজ্জিত হয়ে তার আলোকে সমাজ-বিপ্লবের পথে এগিয়ে আসার জন্য। কেননা, বিপ্লবী সমাজ প্রতিষ্ঠা না হলে এ ধরনের আন্দোলন রাষ্ট্রীয়-দলীয় দমনের মুখে বা কিছু সংস্কার করে পথ হারিয়ে ফেলে। এবং প্রায় ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি কার্যত একই থেকে যায়।
১৫। রোহিঙ্গা সমস্যা
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে সরকারের দুর্বলতা হলো চীন, রাশিয়া ও ভারত রাষ্ট্রকে বলিষ্ঠ বিরোধিতা করায় তার ব্যর্থতা। এ কারণেই তারা মিয়ানমার সামরিক জান্তার সাথে আপসমুখী নীতি নিচ্ছে। অন্যদিকে মার্কিন ও পশ্চিমা সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতার কারণে তাদের সাথেও আপস করছে।
রোহিঙ্গা জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মূল সমস্যাকে তারা আড়াল করছে। একইসাথে ঐ অ লে ও দেশজুড়ে রোহিঙ্গা জনগণের বিরোধী উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী অপচেতনাকেও পানি দিচ্ছে।
এসবের ফলে রোহিঙ্গা জনগণ এক মানবেতর ও অনিশ্চিত জীবনে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন।
আমরা রোহিঙ্গা জনগণকে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল সরকারগুলোর ভিক্ষার উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেদের মুক্তির জন্য বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরছি।
আন্তর্জাতিক
১। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব ও ইউক্রেন যুদ্ধ
সামাম্রাজ্যবাদীদের বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি গুরুতর আকার ধারণ করেছে। যার অনিবার্য প্রকাশ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মোড়লীপনার একমেরু বিশ্ব ভেঙ্গে পড়েছে।
এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়া, আরো তীব্র হওয়া ও বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা কিনা একটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে এবং সার্বিক বা সীমিত পারমাণবিক যুদ্ধের দিকেও বিশ্বকে চালিত করতে পারে।
এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাই, বিশ্ব জনগণের সাথে আমাদেরকেও এই যুদ্ধ-চক্রান্তের বিরোধিতা করতে হবে এবং যুদ্ধ-বিস্তারের পক্ষে যেকোনো ধরনের সাম্রাজ্যবাদী বা তাদের দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি শাসকশ্রেণির পদক্ষেপকে উন্মোচন করতে হবে। আমাদেরকে বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধ-প্রস্তুতিকে ভণ্ডুল করে দিতে হবে। আর যদিই বা যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে তাকে বিপ্লবী যুদ্ধে পরিণত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
২। বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের সংগ্রাম
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব-ব্যবস্থা, তার বিভিন্ন পলিসি ও যুদ্ধ-চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিশ্বের বহু দেশে জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চলছে। তার মাঝে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারত ও ফিলিপাইনের জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম। এছাড়া কিছু সময় আগে ভারতের কৃষকদের এক দীর্ঘস্থায়ী গণসংগ্রাম, আমেরিকায় কালো জনগণের উপর নিপীড়ন বিরোধী সংগ্রাম, সম্প্রতি ফ্রান্সের জনগণের সংগ্রাম সারা দুনিয়ার জনগণের দৃষ্টি কেড়েছে।
আমরা এ ধরনের বিপ্লবী ও প্রগতিশীল সংগ্রামকে উচ্ছ্বসিত সমর্থন জানাই ও এ সম্মেলন থেকে তাদেরকে মোবারকবাদ জানাই।
৩। বিশ্বের নিপীড়িত জাতিসমূহের সংগ্রাম
ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, কুর্দিস্থান, উত্তর-পূর্ব ভারতের জাতিসত্তাসহ বিশ্বের দেশে দেশে নিপীড়িত জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রামকে এ সম্মেলন থেকে আমরা উষ্ণ সমর্থন জানাই।
৪। ভারতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিকাশ
এ সম্মেলন উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি, মোদি ও তার সহযোগীদের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের দৌরাত্ম দিন দিন বেড়ে চলেছে। মুসলিম জনগণের উপর বিবিধ নিপীড়ন জারী রয়েছে ও বাড়ছে। তাদেরই মদদে মনিপুর রাজ্যে এক ভ্রাতৃঘাতী জাতিগত সংঘাতে বহু মানুষ নিহত-আহত হয়েছেন ও হচ্ছেন। এসবের বিরুদ্ধে ভারতের বিপ্লবী, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তি সাহসী সংগ্রাম পরিচালনা করছেন। আমরা এই ক্রমবর্ধিত হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদকে নিন্দা জানাই এবং তার বিরুদ্ধে ভারতের জনগণের সংগ্রামকে সালাম জানাই।
৫। ইরান-আফগানিস্তানে নারীর বিরুদ্ধে ধর্মবাদী জেহাদ
ইরানে মাসা আমিনির হত্যার সূত্র ধরে সেখানকার ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে প্রধানত বিপুল নারীসহ ব্যাপক জনগণের যে বিশ্ব কাঁপানো সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল তাকে এ সম্মেলন থেকে আমরা উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন জানাই।
একইসাথে আমরা আফগানিস্তানে ধর্মবাদীদের দ্বারা নারীর বিরুদ্ধে জারি করা বিবিধ মধ্যযুগীয় নিপীড়ন ও দমনকে নিন্দা জানাই।
এসবের সূত্র ধরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা এসব দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তকেও আমরা নিন্দা জানাই। ইরান-আফগানিস্তানের নিপীড়িত নারী ও জনগণকে আমরা বিপ্লবী রাজনীতির আলোকে সজ্জিত হওয়া ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে আগুয়ান হবার আহ্বান জানাচ্ছি।
৬। ইউরোপীয় কিছু দেশে কোরআন পোড়ানো
সম্প্রতি ডেনমার্ক ও সুইডেনসহ কিছু দেশে কোরআন পোড়ানোর মাধ্যমে ইসলামোফোবিয়াকে উস্কে দেয়া হচ্ছে। যার পরিণতি হলো, ধর্মের ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি, সাম্রাজ্যবাদের মূল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়ে তাকে রক্ষা করা এবং একইসাথে মুসলিম মৌলবাদী ফ্যাসিবাদকে শক্তিশালী হতে শর্ত জোগানো।
আমরা এ ধরনের নৈরাজ্যকর ও চক্রান্তমূলক অপতৎপরতাকে নিন্দা জানাই এবং মত প্রকাশের নামে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ঘোষণাকে বিরোধিতা করি। একইসাথে এর সুযোগ নিয়ে মুসলিম ধর্মবাদীদের মধ্যযুগীয় তৎপরতারও নিন্দা জানাই।
আরও খবর
- শনি
- রোব
- সোম
- মঙ্গল
- বুধ
- বৃহ
- শুক্র