• বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২ আশ্বিন ১৪৩২
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চলতি রাজনৈতিক কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চলতি রাজনৈতিক কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে

  আন্দোলন প্রতিবেদন  

শুক্রবার, ২১ জুন ২০২৪  |  অনলাইন সংস্করণ

ভারতের নির্বাচন

ভারতে আর যা-ই হোক নির্বাচনটা এখনো মোটামুটি ভাবে ভালোই হয়। অবশ্য বুর্জোয়া নির্বাচন। যাতে ভারতের শত কোটি কৃষক, শ্রমিক ও দরিদ্র-মধ্যবিত্ত জনগণের কোনোই ফায়দা নেই। তবুও তো জনগণ বুর্জোয়াদের মধ্যে থেকেই কাউকে বেছে নেবার একদিনের একটা স্বাধীনতা এখনো ভোগ করেন। তাই, ভোটের ফলাফলের কিছু গুরুত্ব রয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, মোদি আবার জিতে গেছে। কিন্তু তার আসন সংখ্যা অনেক কমে গেছে। যদিও মোদির পার্টি বিজেপি সর্বাধিক আসনে জয় পেয়েছে– ২৪০টি, কিন্তু সেটা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। সেজন্য ২৭৩ আসন পেতে হতো। তার একটি জোট রয়েছে এনডিএ। তাই জোটের সাহায্যেই সরকার গঠন করতে হবে তাকে– জোটের আসন সংখ্যা ২৯২। মোদিই থাকছে।

অবশ্য চতুর ও ধুর্ত মোদি এটা বুঝেই আগ বাড়িয়ে স্লোগান তুলেছিল– “আগলিবার, ৪০০ পার”– অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে (এবারটায়) ৪০০ আসন পার হয়ে যাবে তারা। কিন্তু সেটা তো পায়ই নি, উপরন্তু নির্বিঘ্নে সরকার গঠনই কঠিন হয়ে গেছে। ভোটের বাতাস বুঝেই সে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে ভোটের আগে জেলে ভরেছিল। কংগ্রেসের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছিল। দেশজুড়ে বহু অজুহাতে ইন্ডিয়া জোটের উপর দমন চালিয়েছে। একারণে স্বয়ং কেজরিওয়াল বলেছেন যে, মোদি বাংলাদেশের শেখ হাসিনার মতো করে ভোট-জালিয়াতি করতে চাচ্ছে। এবারের ফলাফলে মনে হচ্ছে, আগামীতে মোদিকে হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদের নির্বাচনি ‘কৌশল’-কে আরো ভালোভাবে প্রয়োগ করতে হবে। হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনে বাংলাদেশ তাহলে এই বিষয়ে বিশ্বের স্বৈরাচারী শাসকদের ভালো শিক্ষক হতে পেরেছে!

ভোটের ফল বেরিয়েছে ৪ তারিখে জুন। ৫ তারিখেই শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোদিকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। অথচ মোদির সরকার গঠনে তখনো অনিশ্চয়তা ছিল। আবার এও বলেছে, যে ফলই হোক না কেন, ভারতের সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব একই থাকবে। তা কি আর বলতে!

ভারতের ভোটের ফল এটা দেখিয়েছে যে, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে মোদি-বিজেপি-আরএসএস-আম্বানি-আদানি শত ষড়যন্ত্র করলেও জনগণ থেকে তাদের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। সে কারণে মোদির প্রয়োজন হবে আগামীতে আরেকটি গুজরাট দাঙ্গার মতো মুসলিম নিধন বাধানো। এবং হাসিনা-আওয়ামী নির্বাচনি কৌশলকে আরো কার্যকর ভাবে প্রয়োগ করা।

কংগ্রেস/ইন্ডিয়া জোট ভারতের জনগণ ও পার্শ্ববর্তী দেশ/জাতি/জনগণের জন্য কোনো ইতিবাচক কিছু নয়। তাদের শক্তিশালী হওয়া তাদের নিজেদের কোনো ইতিবাচকতার জন্য নয়, বরং মোদির হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ। তবে এটা প্রমাণ করছে, ভারতের রাষ্ট্র ও সর্বভারতীয় শাসকশ্রেণি দুর্বল হয়ে পড়ছে, যে দুর্বলতা জনগণের জন্য শুভকর। ভারত রাষ্ট্র যত দুর্বল হবে, সর্বভারতীয় শাসকশ্রেণি যত অসুবিধায় থাকবে, তত এ অঞ্চলের দেশ ও জনগণ ভালো থাকবে। তাই মোদির পরাজয় ছিল কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু তার হিন্দুত্ববাদ এখনো বুর্জোয়া রাজনীতিতে ভারতে এগিয়ে রয়েছে। সেটাই ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভাগ্যের বিষয়। আর সেটাই শেখ হাসিনা সরকারের স্বস্তির জায়গা।

আজিজ-বেনজীর– টিপ অব দি আইসবার্গ

বেনজীর ও আজিজের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতি ও ক্ষমতার ব্যবহার/অপ-ব্যবহারের অভিযোগ উঠছে তা মিডিয়ার মাধ্যমে অনেকেই জানেন। তবে বেনজীরের আলোচনাটা বেশি হচ্ছে। তার প্রচারিত সম্পদ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে মাত্র সাড়ে ছয়শো বিঘার মতো জমি, ব্যাংকে শত কোটি টাকা, গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট ছাড়াও মালয়েশিয়া, স্পেনে সেকেন্ড হোম ও ব্যবসা-বাণিজ্য; তুরস্কেও। আরো অনেক কিছু তো গোপনই রয়েছে, তাই না?

এগুলো যে তিনি ঘুস খেয়ে, জোর করে দখল করে, দুর্নীতি করে ‘অর্জন’ করেছেন তা কে না বোঝে। অবশ্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দোষ করলে বিচার হবে। কিন্তু তার আগেই তো তিনি পগার পার। পালিয়েছে কিনা তা অবশ্য মন্ত্রীরা জানেন না বলছেন। বেনজীরের প্রচারে আরো বড় বোয়াল সেনা-প্রধান আজিজের সফলতাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা তো স্পষ্ট যে, শেখ হাসিনার আশীর্বাদধন্য এই দুই সশস্ত্র আমলা একা একাই এগুলো করেননি। এতো যে করিৎকর্মা ডিবি হারুন সাহেব, উনারা কি কিছুই জানতেন না? অথবা যিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী, শেখ হাসিনা নিজে, তিনি কি জানতেন না? কেমন তাহলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা? 

এটা সহজবোধ্য যে, এ দুজন হলেন সমগ্র আমলাতন্ত্র, মন্ত্রীবর্গ, আওয়ামী নেতা ও ব্যবসায়ী নামের বিশাল লুটেরা শ্রেণির শীর্ষ দুইজন মাত্র। হিমবাহের ভেসে থাকা মাথা। কে সমগ্রটাকে উঠিয়ে ন্যাংটা করার সাহস রাখে?

প্রশ্ন হলো, আজিজেরটা না হয় বোঝা গেল আমেরিকা করেছে, কিন্তু বেনজীরকে কেন এখন বিপদে পড়তে হলো? এটা এক বড় প্রশ্ন। গোপালগঞ্জের এই কৃতি সন্তান হাসিনা সরকারের অতি প্রিয়ভাজন ব্যক্তি। না হলে ঢাকা মহানগরীর পুলিশ-প্রধান, র‍্যাব প্রধান, আর স্যাংশন খাওয়ার পরও সমগ্র পুলিশ প্রধান! কার এতো ভাগ্য? 

আগেও প্রিয় ছিলেন, পরেও থাকার কথা। কিন্তু থাকা গেল না। হয় বিপুল দুনর্ীতির বিশ্ব-প্রচারে ও আমেরিকার চাপে তাকে বলির পঁাঠা করা হয়েছে। নতুবা তিনি কোনো কারণে ক্ষমতা থেকে যাবার পর হাসিনা সরকারের কোনো না কোনো অংশের বিরাগভাজন হয়েছেন।

কাদের বলছেন, দোষী হলে বিচার হবে। কে কার বিচার করে?

একজন ‘জনপ্রতিনিধি’ ও একজন ‘চরমপন্থি’ নেতা

ঝিনেদা’র এক এমপি, সংক্ষিপ্ত নাম হলো আনার, ভারতে গিয়ে খুন হয়েছেন দৃশ্যত বাংলাদেশি খুনিদের হাতে। খুনিরা তারই বন্ধু, ব্যবসায়িক পার্টনার ও রাজনৈতিক সঙ্গী। সব আওয়ামী লীগ। ব্যবসা মানে চোরাচালানি, স্বর্ণ পাচার, অর্থ পাচার, হুন্ডি, নারী ব্যবসা, মাদক ব্যবসা– ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রধান আসামী যাকে মনে করা হচ্ছে– শাহিন, তিনিও আওয়ামী নেতা। তার ভাই উপজেলা মেয়র। এদের সবার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র, তা বোঝা যাবে সাথে যে সেলেস্তি নামের তরুণী ভাড়াটে মেয়েটি ধরা পড়েছে তার কথা-বার্তা থেকে।

কলকাতার অভিজাত এলাকায় বাড়ি ভাড়া করে এমপি-কে নিয়ে গিয়ে ঘরে বসেই খুন করা হয়েছে। তারপর তার লাশ নিয়ে যা কিছু করা হয়েছে সেগুলো করে থাকে এইসব ফ্যাসিবাদী গডফাদার ও তাদের বিবিধ সরকারি/বেসরকারি বাহিনীগুলোই, তাদের শত্রু রাজনীতিক কর্মী/নেতাদের বিরুদ্ধে– যা অবশ্য ডিপজল-মার্কা ভিলেনদেরকে করতে দেখা যেতো ঢাকাইয়া সিনেমাগুলোতেও।

এমন মাপের এক ক্রিমিনাল গডফাদার আওয়ামী সরকারের পূর্বেই ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত আসামী ছিল। মজার ব্যাপার হলো, কাদের সাহেব বলেছেন, তা সত্ত্বেও তার জনপ্রিয়তার কারণেই তাকে তিন তিনবার তাকে এমপি বানানো হয়েছে। আর এমপি হবার পর সব মামলা, অভিযোগ সাফ হয়ে গেছে। তো, দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী এমপি-দের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি কী? যে যত বড় সন্ত্রাসী, গডফাদার, ক্রিমিনাল, সে তত জনপ্রিয়(দুঃখিত! হয়তো সবাই নয়)। তাকে কেন মন্ত্রীসভায় নেয়া হলো না সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।

দেখা যাচ্ছে, এই ‘জনপ্রতিনিধি’র খুনের সাথে শাহিন নামের প্রধান ব্যক্তির সাথে শিমূল নামের এক ‘চরমপন্থি’ নেতার নামও রয়েছে। বলা হচ্ছে, এই ব্যক্তি নাকি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নামের এক চরমপন্থি দলের নেতা। তিনি অতীতে কী ছিলেন, বা তার কোন আত্মীয় কে, সেগুলোর বদলে যদি তার বর্তমান বা সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস দেখা যায় তাহলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, তিনিও আওয়ামী লীগেরই লোক। তার ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যানকে হত্যা করে তার ভাইকে নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান বানিয়েছেন তিনি। তার স্ত্রী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদের সদস্য– আওয়ামী লীগের। তিনি এ পরিবারের কর্তা। তিনি কীভাবে চরমপন্থি দলের নেতা হয়ে যান! অথচ বুর্জোয়া মিডিয়াগুলো অবিরাম সেটা প্রচার করে চলেছে। দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে– এক, চরমপন্থি নামে ট্যাগ দেয়া মাওবাদী দলকে বদনাম দেয়া; দুই, আওয়ামী কানেকশন ও তাদের অপকর্মকে যতটা পারা যায় ধামাচাপা দেয়া।

জানা যায় যে, শিমূল এক সময় (প্রায় ত্রিশ বছর আগে) এ অঞ্চলে সক্রিয় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী/নেতা ছিলেন। কিন্তু তার পর পার্টির সেখানে বিপর্যস্ত হয়ে যাবার পরে শিমূলের রাজনৈতিক ইতিহাস কী সেটা উপরেই বলা হয়েছে। বিপ্লবী পার্টি থেকে রাজনীতিগতভাবে অধঃপতিত হয়ে বুর্জোয়া পার্টির নেতা হওয়া বা তাদের আশ্রয়ে ক্রিমিনাল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। শিমূলের ঘটনাটা সেরকমই একটা। কিন্তু ডিবি-নেতা বা বুর্জোয়া মিডিয়া এই আওয়ামী পরিবারের ক্রিমিনালকে এখন বানিয়েছে মাওবাদী নেতা। বলছে চরমপন্থি। অথচ, যে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা পুলিশ উপরোক্ত ধরনের বহু বহু অপরাধের হোতা তাদেরকে কখনো তারা চরমপন্থি বলে না। আনারও চরমপন্থি নয়, নির্বাচিত এমপি, জনপ্রিয় নেতা। শেখ হাসিনাকেও তারা চরমপন্থি নেতা বলে না। কারণ, তারা রাতের বাহিনী করে না, দিনে দুপুরে দুকান কাটার মতো করে দিনে দুপুরেই করে চলেছে। কারণ, তারা রাষ্ট্রক্ষমতায়।

এইসব জনপ্রিয় নেতা ও ক্রিমিনাল গডফাদারদের কে তৈরি করে আর কে রক্ষা করে?

উপজেলা নির্বাচন

কেমন হলো উপজেলা নির্বাচন? সিইসি বলেছেন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে তিনি “খুবই সন্তুষ্ট”। সন্তুষ্ট হবারই কথা। কারণ, দু’একটি বাদে সবই আওয়ামী লীগ। যে কয়জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন, বোমা গুলি ফুটেছে সেসব হয়েই থাকে। তবু তো ৩৫/৪০ ভাগ ভোট পড়েছে। কম কী? প্রধানমন্ত্রী যদি প্রতীক বাদ দেয়ার ঐ বুদ্ধিটা বের না করতেন তাহলে তো......। অবশ্য পত্রিকা টিভির ছবিতে দেখা গেছে কেন্দ্রগুলোতে ভোটার নেই। খা খা খালি মাঠ। তাতে কী? হিসেবে তো ৩৮%। বিরাট সফলতা। জনগণ ভোট দিয়েছেন বলেই না আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়! ঠিক না?

শেখ হাসিনা বুর্জোয়া ব্যবস্থাটির যে ক্ষতি করেছেন তা সুদীর্ঘ ৫ দশকে বিপ্লবীরাও করতে পারেন নি। তিনি সমগ্র বুর্জোয়া নির্বাচনি ব্যবস্থাটিকেই ধ্বংস করে ফেলেছেন। ভালো। এটা খারাপ নয়। খারাপ হলো জনগণ কী করবেন তাহলে? চলবে এভাবেই? জনগণকে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আন্দোলনের পথে যেতে হবে। নির্বাচন দাবি কোনো পথ নয়। ফ্যাসিবাদের অবসানে শ্রমিক-কৃষক-জনতার একটি গণসরকার গঠনের বিপ্লবী পথেই এগোতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চীন সফরে দাওয়াত দিয়েছে– ৯ জুলাই। চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এটা ‘গেমচেঞ্জার’ সফর হবে। হুমকিটা কি ভারতের বিরুদ্ধে, নাকি আমেরিকার? হয়তো দুটোই। হাসিনা-আওয়ামী লীগের তো উপায় নেই। চীনের সাথে খাতির করতেই হবে। আমেরিকা তাকে চাপে রেখেছে। আর্থিক সংকটে আইএমএফ অল্প কিছু টাকা দিয়েছে বটে। কিন্তু সেজন্য যেসব শর্ত হাসিনাকে হজম করতে হয়েছে তাতে তার নাভিশ্বাস। যদিও ভারত তার ক্ষমতার মূল বৈদেশিক উৎস, কিন্তু ভারতের সামর্থ্য নেই হাসিনা সরকারের আর্থিক সংকট সেভাবে সামাল দেয়ার। তাই, তাকে চীনা তহবিলের জন্য ছুটতেই হবে। আর আমেরিকার চাপ সহ্য করতে হলে এখন তার চীন সাপোর্ট প্রয়োজন বটে। এটা দিয়ে আবার আমেরিকার সাথে দরাদরিটাও চলে।

চীনও খেলছে। এ অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব কমানোর জন্য বাংলাদেশ তার জন্য খুব দরকার। পদ্মা সেতু তারা করে দিয়েছে। হাসিনার মান রক্ষা করেছে। এখন আর্থিক খাতের দুর্গতি নাশে হাসিনার পাশে থাকলে বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলার সুযোগ রয়েছে।

কিন্তু তাহলে ভারত? তার কী হবে? সে-ই তো হাসিনার আসল প্রভু। তাকে না বলে চীনে গেলে চলে? তাই, ভারতের ভোট হতে না হতে, নতুন সরকার বানাতে না বানাতে সেখানে সফরের দিন কাল প্রায় ঠিক। চীন সফরের আগেই সম্ভবত ২১ জুন প্রধানমন্ত্রী ভারতে যাচ্ছেন বলে অনুমিত হচ্ছে। অবশ্য তার আগেই মোদি-উৎসবে দাওয়াত রয়েছে।

এসব সফরকে নিছক বন্ধুত্ব ও অর্থনৈতিক লেন-দেন ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এ হলো প্রভুদের কাছে দালালদের ছুটোছুটি। হাসিনা-আওয়ামী সংকট এতে বাড়বে বৈ কমবে না। আমেরিকা বসে বসে আঙুল চুষবে না। ভারতও চীন-মাখামাখি বাঁকা চোখেই দেখবে। তিস্তা ব্যারেজের চীনা প্রস্তাব হাসিনা করবেন না, খবরদার, ভারত কিন্তু সহ্য করবে না। বেশি আগালে খবর আছে। 

আবারো বাজেট, আবারো ... ...

চলমান ব্যবস্থায় প্রতিবছর সরকার একটি করে বাজেট দেয়। এটা হলো বিগত বছরে নিজেদের আয় ব্যয়ের হিসেব ও আগামী বছরের সম্ভাব্য হিসেব। এতে জনগণের বিশেষ কোনো আগ্রহ থাকার বিষয় নেই। তবে বুর্জোয়া মিডিয়া এটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কারণ এটা তাদের জন্য বড় এক বিষয়। বিশেষত ব্যবসায়ী শিল্পপতি এদের জন্য। তাদের নিজেদেরও লাভ-ক্ষতির হিসেব। জনগণের বিবেচনার দিক হলো কোন নিত্য পণ্যগুলোর দাম বাড়বে তা জানা। যদিও বাজেটকে তোয়াক্কা না করেই সারা বছর ধরেই জনগণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বাড়ানো হয়।

এবারও প্রচলিত নিয়মে কিছু জিনিষের দাম বাড়বে। কিন্তু জনগণের জন্য বর্তমানের বড় মাথা ব্যথার কারণ হলো, জ্বালানিতে বরাদ্দ কম রাখা হয়েছে। অথচ নিয়মিতভাবে বাড়বে গ্যাস-বিদ্যাুতের দাম। যার ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদনের খরচ বাড়বে। ফোনের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে শাসকশ্রেণির লোকদের জন্য লক্ষ লক্ষ কোটি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দান থাকছে।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছরই বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন দাবি করে থাকে। কিন্তু তা বিশ্বমানের চেয়ে বহু নিচে থাকে। অন্যদিকে আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনী– যারা আসলে জনগণের কোনো কাজ করে না, জনগণের টাকা তাদের জন্যই বিরাটভাবে বরাদ্দ করা হয়। বর্তমান বাজেট বাস্তবায়নের জন্য দাতা সংস্থাগুলোর কাছে ২০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সুতরাং এই বাজেটও সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর থাকছে।

আমাদের দেশে বর্তমানে যে হাসিনাতন্ত্র চলছে, তাতে এমনকি তাদের নিজেদের বাজেট নিয়েও তারা সংসদে খুব কমই আলোচনা করে। প্রায় বিনাতর্কেই সব পাশ হয়ে যায়। সংসদ হলো শুধু সিল মারার হাতিয়ার। সাংসদদের বেতন ভাতা সুযোগ সুবিধা ভালোই থাকবে। যদিও এসব লক্ষ টাকার বেতনে তাদের কিছুই যায় আসে না। তাদের মূল আয় যে কী সেটা এমপি আনার ভালোই জানতো।

তথাপি বাজেটের সূত্র ধরে যে আলোচনা ও প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি হয় তাকে কাজে লাগানো উচিত। বাজেটের উন্মোচন প্রয়োজন। একইসাথে জনগণের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, অন্যায় কর বাতিল করণ– এসব বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

কেএনএফ– পাহাড়ে নতুন তৎপরতা

কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় কেএনএফ (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) নামের সংগঠনটির তৎপরতা জাতীয় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। অবশ্য সংগঠনটি একেবারে নতুন এমন নয়। বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক কাজের মধ্য দিয়ে তারা বেশ কিছু বছর আগে থেকেই কাজ করছিল। কিন্তু বছর দুই আগে প্রথম তাদের নাম মিডিয়ায় উঠে আসে তাদের সশস্ত্র কার্যক্রমের সূত্র ধরে। একটি মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন ‘হিন্দাল’ গোষ্ঠীর জঙ্গিদেরকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল বলে সরকারি সংস্থাগুলো দাবি করে। সেখানে অভিযান চালিয়ে কিছু জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। তবে মূল কেএনএফ সংগঠনটি তাদের ঘাঁটি ছেড়ে পাহাড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় থেকেই তাদের সশস্ত্র তৎপরতা, তাদের প্রধান নেতা নাথান বম এবং তাদের কর্মসূচি ইত্যাদি নিয়ে কিছু আলোচনা দেখা যায়।

তখন শোনা যায় তাদের সাথে সরকারের একটি শান্তি-আলোচনা চলছে। কিন্তু হঠাৎ করেই তারা এ বছরের প্রথমদিকে বান্দরবান জেলার একটি ব্যাংকে হামলা করে। সরকারি সূত্র বলছে যে, কয়েক শ’ সশস্ত্র ব্যক্তি ব্যাংকটিতে হামলা করে, সেখানকার পাহারায় রত আনসার/পুলিশদের ১৪টি অস্ত্র দখল করে নেয় এবং ব্যাংকটির ম্যানেজারকে অপহরণ করে। পরে জানা যায় যে, বড় অঙ্কের মুক্তিপণ নিয়ে তাকে তারা ছেড়ে দেয়, যদিও এ বিষয়ে সরকারি পক্ষ গোপনীয়তা রক্ষা করে।

তাদের ঘোষিত কর্মসূচিতে দেখা যায় যে, তারা তাদের অঞ্চলটিকে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল করার দাবিতে সংগ্রাম করছে। এ সংগঠনে রয়েছে, তাদের দাবি মতো, ৬টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ১৩টি জাতিসত্তার সবচেয়ে সংখ্যালঘু অংশ। এর আগে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন বা এমনকি স্বাধীনতার জন্য সেখানে সংগ্রাম করেছে যে সংগঠন- “জনসংহতি সমিতি”, তাতে প্রাধান্য ছিল চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জাতিসত্তার নেতৃত্বদের। পরে এ সংগঠন কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হলেও সবগুলোতেই ঘুরে ফিরে মূলত এ তিনটি জাতিসত্তারই কর্তৃত্ব রয়েছে। ফলে এদের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ধারা হিসেবে কেএনএফ নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

কেউ বলতে চায় যে, পাহাড়ি জনগণের জাতিগত সংগ্রামে ভাঙন সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র এদের তৈরি করেছে। আবার এখন কোনো কোনো বুর্জোয়া বিশ্লেষকের মতে ভারত এদের দিয়ে এবং এদের সাথে ভারতের কুকি-চীনদের একত্র করে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পাঁয়তারা করছে, যে রাষ্ট্রটি হবে ভারতেরই একটি বাফার স্টেট। যেটি কিনা মিয়ানমারের চীনাপন্থি শক্তিগুলোর বিপক্ষে ভারতের নিরাপত্তায় একটি দেয়াল হিসেবে কাজ করবে। 

কিন্তু এসব জল্পনা যা-ই হোক না কেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যকে ফেলে দেয়া যাবে না। তিনি স্পষ্টতই মার্কিনকে ইঙ্গিত করে বলেছেন যে, তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু খ্রিষ্টান শক্তির সমন্বয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করছে। প্রসঙ্গত কুকিরা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। মিয়ানমারের চীন প্রদেশটি এখন কার্যত সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত এবং সেখানে এই জাতিসত্তার জনগণের মুক্ত এলাকা গঠিত হয়েছে। আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ যে, গত বছর ভারতের মনিপুরে কুকিদের বিরুদ্ধে একটি বড় জাতিগত দাঙ্গা বাধানো হয়েছিল, যাতে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বিজেপি’র বড় হাত ও ইন্ধন ছিল বলে প্রচার রয়েছে। তাই, সেখানকার নিপীড়িত কুকিরা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর কুকিদের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় করতেই পারেন। কেএনএফ-এর বাহিনীও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিযানে ভারত বা অন্য কোথাও চলে যায় বা গিয়েছে বলেও বলা হয়ে থাকে।

সুতরাং বিষয়টা এখানকার খুবই সংখ্যালঘু কুকিদের একটি ছোট তৎপরতা নয় বলেই মনে হয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে এবং ভারত ও মিয়ানমারের সন্নিহিত অঞ্চলে এখন বিশেষ টালমাটাল অবস্থা চলছে। এখানে বিশ্ব ও আঞ্চলিক প্রভুত্ব ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলো খুবই সক্রিয়। তাই, কেএনএফ-তৎপরতা খুবই মনোযোগ দাবি করে। একই সাথে এখানকার জাতিগত আন্দোলনগুলোর রয়েছে ন্যায্যতা, যা বিবিধ শক্তিকে সেখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি করে দেয়। যত ছোটই হোক, প্রত্যেক জাতিসত্তার অধিকার রয়েছে স্বায়ত্তশাসনের। তবে সে আন্দোলন তখনই সফলতার দিকে এগোতে পারে যদি তা বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ বিরোধী নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাথে মৈত্রী গঠন করে। তা না হলে তাদের পক্ষে ঐ শত্রুপক্ষগুলোর হাতিয়ার হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকবেই। কেএনএফ কোন পথে এগুচ্ছে তা আগামীতে আরো স্পষ্ট হবে নিশ্চয়ই।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চলতি রাজনৈতিক কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে

 আন্দোলন প্রতিবেদন 
শুক্রবার, ২১ জুন ২০২৪  |  অনলাইন সংস্করণ

ভারতের নির্বাচন

ভারতে আর যা-ই হোক নির্বাচনটা এখনো মোটামুটি ভাবে ভালোই হয়। অবশ্য বুর্জোয়া নির্বাচন। যাতে ভারতের শত কোটি কৃষক, শ্রমিক ও দরিদ্র-মধ্যবিত্ত জনগণের কোনোই ফায়দা নেই। তবুও তো জনগণ বুর্জোয়াদের মধ্যে থেকেই কাউকে বেছে নেবার একদিনের একটা স্বাধীনতা এখনো ভোগ করেন। তাই, ভোটের ফলাফলের কিছু গুরুত্ব রয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, মোদি আবার জিতে গেছে। কিন্তু তার আসন সংখ্যা অনেক কমে গেছে। যদিও মোদির পার্টি বিজেপি সর্বাধিক আসনে জয় পেয়েছে– ২৪০টি, কিন্তু সেটা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। সেজন্য ২৭৩ আসন পেতে হতো। তার একটি জোট রয়েছে এনডিএ। তাই জোটের সাহায্যেই সরকার গঠন করতে হবে তাকে– জোটের আসন সংখ্যা ২৯২। মোদিই থাকছে।

অবশ্য চতুর ও ধুর্ত মোদি এটা বুঝেই আগ বাড়িয়ে স্লোগান তুলেছিল– “আগলিবার, ৪০০ পার”– অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে (এবারটায়) ৪০০ আসন পার হয়ে যাবে তারা। কিন্তু সেটা তো পায়ই নি, উপরন্তু নির্বিঘ্নে সরকার গঠনই কঠিন হয়ে গেছে। ভোটের বাতাস বুঝেই সে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে ভোটের আগে জেলে ভরেছিল। কংগ্রেসের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছিল। দেশজুড়ে বহু অজুহাতে ইন্ডিয়া জোটের উপর দমন চালিয়েছে। একারণে স্বয়ং কেজরিওয়াল বলেছেন যে, মোদি বাংলাদেশের শেখ হাসিনার মতো করে ভোট-জালিয়াতি করতে চাচ্ছে। এবারের ফলাফলে মনে হচ্ছে, আগামীতে মোদিকে হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদের নির্বাচনি ‘কৌশল’-কে আরো ভালোভাবে প্রয়োগ করতে হবে। হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনে বাংলাদেশ তাহলে এই বিষয়ে বিশ্বের স্বৈরাচারী শাসকদের ভালো শিক্ষক হতে পেরেছে!

ভোটের ফল বেরিয়েছে ৪ তারিখে জুন। ৫ তারিখেই শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোদিকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। অথচ মোদির সরকার গঠনে তখনো অনিশ্চয়তা ছিল। আবার এও বলেছে, যে ফলই হোক না কেন, ভারতের সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব একই থাকবে। তা কি আর বলতে!

ভারতের ভোটের ফল এটা দেখিয়েছে যে, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে মোদি-বিজেপি-আরএসএস-আম্বানি-আদানি শত ষড়যন্ত্র করলেও জনগণ থেকে তাদের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। সে কারণে মোদির প্রয়োজন হবে আগামীতে আরেকটি গুজরাট দাঙ্গার মতো মুসলিম নিধন বাধানো। এবং হাসিনা-আওয়ামী নির্বাচনি কৌশলকে আরো কার্যকর ভাবে প্রয়োগ করা।

কংগ্রেস/ইন্ডিয়া জোট ভারতের জনগণ ও পার্শ্ববর্তী দেশ/জাতি/জনগণের জন্য কোনো ইতিবাচক কিছু নয়। তাদের শক্তিশালী হওয়া তাদের নিজেদের কোনো ইতিবাচকতার জন্য নয়, বরং মোদির হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ। তবে এটা প্রমাণ করছে, ভারতের রাষ্ট্র ও সর্বভারতীয় শাসকশ্রেণি দুর্বল হয়ে পড়ছে, যে দুর্বলতা জনগণের জন্য শুভকর। ভারত রাষ্ট্র যত দুর্বল হবে, সর্বভারতীয় শাসকশ্রেণি যত অসুবিধায় থাকবে, তত এ অঞ্চলের দেশ ও জনগণ ভালো থাকবে। তাই মোদির পরাজয় ছিল কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু তার হিন্দুত্ববাদ এখনো বুর্জোয়া রাজনীতিতে ভারতে এগিয়ে রয়েছে। সেটাই ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভাগ্যের বিষয়। আর সেটাই শেখ হাসিনা সরকারের স্বস্তির জায়গা।

আজিজ-বেনজীর– টিপ অব দি আইসবার্গ

বেনজীর ও আজিজের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতি ও ক্ষমতার ব্যবহার/অপ-ব্যবহারের অভিযোগ উঠছে তা মিডিয়ার মাধ্যমে অনেকেই জানেন। তবে বেনজীরের আলোচনাটা বেশি হচ্ছে। তার প্রচারিত সম্পদ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে মাত্র সাড়ে ছয়শো বিঘার মতো জমি, ব্যাংকে শত কোটি টাকা, গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট ছাড়াও মালয়েশিয়া, স্পেনে সেকেন্ড হোম ও ব্যবসা-বাণিজ্য; তুরস্কেও। আরো অনেক কিছু তো গোপনই রয়েছে, তাই না?

এগুলো যে তিনি ঘুস খেয়ে, জোর করে দখল করে, দুর্নীতি করে ‘অর্জন’ করেছেন তা কে না বোঝে। অবশ্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দোষ করলে বিচার হবে। কিন্তু তার আগেই তো তিনি পগার পার। পালিয়েছে কিনা তা অবশ্য মন্ত্রীরা জানেন না বলছেন। বেনজীরের প্রচারে আরো বড় বোয়াল সেনা-প্রধান আজিজের সফলতাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা তো স্পষ্ট যে, শেখ হাসিনার আশীর্বাদধন্য এই দুই সশস্ত্র আমলা একা একাই এগুলো করেননি। এতো যে করিৎকর্মা ডিবি হারুন সাহেব, উনারা কি কিছুই জানতেন না? অথবা যিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী, শেখ হাসিনা নিজে, তিনি কি জানতেন না? কেমন তাহলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা? 

এটা সহজবোধ্য যে, এ দুজন হলেন সমগ্র আমলাতন্ত্র, মন্ত্রীবর্গ, আওয়ামী নেতা ও ব্যবসায়ী নামের বিশাল লুটেরা শ্রেণির শীর্ষ দুইজন মাত্র। হিমবাহের ভেসে থাকা মাথা। কে সমগ্রটাকে উঠিয়ে ন্যাংটা করার সাহস রাখে?

প্রশ্ন হলো, আজিজেরটা না হয় বোঝা গেল আমেরিকা করেছে, কিন্তু বেনজীরকে কেন এখন বিপদে পড়তে হলো? এটা এক বড় প্রশ্ন। গোপালগঞ্জের এই কৃতি সন্তান হাসিনা সরকারের অতি প্রিয়ভাজন ব্যক্তি। না হলে ঢাকা মহানগরীর পুলিশ-প্রধান, র‍্যাব প্রধান, আর স্যাংশন খাওয়ার পরও সমগ্র পুলিশ প্রধান! কার এতো ভাগ্য? 

আগেও প্রিয় ছিলেন, পরেও থাকার কথা। কিন্তু থাকা গেল না। হয় বিপুল দুনর্ীতির বিশ্ব-প্রচারে ও আমেরিকার চাপে তাকে বলির পঁাঠা করা হয়েছে। নতুবা তিনি কোনো কারণে ক্ষমতা থেকে যাবার পর হাসিনা সরকারের কোনো না কোনো অংশের বিরাগভাজন হয়েছেন।

কাদের বলছেন, দোষী হলে বিচার হবে। কে কার বিচার করে?

একজন ‘জনপ্রতিনিধি’ ও একজন ‘চরমপন্থি’ নেতা

ঝিনেদা’র এক এমপি, সংক্ষিপ্ত নাম হলো আনার, ভারতে গিয়ে খুন হয়েছেন দৃশ্যত বাংলাদেশি খুনিদের হাতে। খুনিরা তারই বন্ধু, ব্যবসায়িক পার্টনার ও রাজনৈতিক সঙ্গী। সব আওয়ামী লীগ। ব্যবসা মানে চোরাচালানি, স্বর্ণ পাচার, অর্থ পাচার, হুন্ডি, নারী ব্যবসা, মাদক ব্যবসা– ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রধান আসামী যাকে মনে করা হচ্ছে– শাহিন, তিনিও আওয়ামী নেতা। তার ভাই উপজেলা মেয়র। এদের সবার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র, তা বোঝা যাবে সাথে যে সেলেস্তি নামের তরুণী ভাড়াটে মেয়েটি ধরা পড়েছে তার কথা-বার্তা থেকে।

কলকাতার অভিজাত এলাকায় বাড়ি ভাড়া করে এমপি-কে নিয়ে গিয়ে ঘরে বসেই খুন করা হয়েছে। তারপর তার লাশ নিয়ে যা কিছু করা হয়েছে সেগুলো করে থাকে এইসব ফ্যাসিবাদী গডফাদার ও তাদের বিবিধ সরকারি/বেসরকারি বাহিনীগুলোই, তাদের শত্রু রাজনীতিক কর্মী/নেতাদের বিরুদ্ধে– যা অবশ্য ডিপজল-মার্কা ভিলেনদেরকে করতে দেখা যেতো ঢাকাইয়া সিনেমাগুলোতেও।

এমন মাপের এক ক্রিমিনাল গডফাদার আওয়ামী সরকারের পূর্বেই ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত আসামী ছিল। মজার ব্যাপার হলো, কাদের সাহেব বলেছেন, তা সত্ত্বেও তার জনপ্রিয়তার কারণেই তাকে তিন তিনবার তাকে এমপি বানানো হয়েছে। আর এমপি হবার পর সব মামলা, অভিযোগ সাফ হয়ে গেছে। তো, দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী এমপি-দের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি কী? যে যত বড় সন্ত্রাসী, গডফাদার, ক্রিমিনাল, সে তত জনপ্রিয়(দুঃখিত! হয়তো সবাই নয়)। তাকে কেন মন্ত্রীসভায় নেয়া হলো না সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।

দেখা যাচ্ছে, এই ‘জনপ্রতিনিধি’র খুনের সাথে শাহিন নামের প্রধান ব্যক্তির সাথে শিমূল নামের এক ‘চরমপন্থি’ নেতার নামও রয়েছে। বলা হচ্ছে, এই ব্যক্তি নাকি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নামের এক চরমপন্থি দলের নেতা। তিনি অতীতে কী ছিলেন, বা তার কোন আত্মীয় কে, সেগুলোর বদলে যদি তার বর্তমান বা সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস দেখা যায় তাহলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, তিনিও আওয়ামী লীগেরই লোক। তার ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যানকে হত্যা করে তার ভাইকে নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান বানিয়েছেন তিনি। তার স্ত্রী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদের সদস্য– আওয়ামী লীগের। তিনি এ পরিবারের কর্তা। তিনি কীভাবে চরমপন্থি দলের নেতা হয়ে যান! অথচ বুর্জোয়া মিডিয়াগুলো অবিরাম সেটা প্রচার করে চলেছে। দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে– এক, চরমপন্থি নামে ট্যাগ দেয়া মাওবাদী দলকে বদনাম দেয়া; দুই, আওয়ামী কানেকশন ও তাদের অপকর্মকে যতটা পারা যায় ধামাচাপা দেয়া।

জানা যায় যে, শিমূল এক সময় (প্রায় ত্রিশ বছর আগে) এ অঞ্চলে সক্রিয় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী/নেতা ছিলেন। কিন্তু তার পর পার্টির সেখানে বিপর্যস্ত হয়ে যাবার পরে শিমূলের রাজনৈতিক ইতিহাস কী সেটা উপরেই বলা হয়েছে। বিপ্লবী পার্টি থেকে রাজনীতিগতভাবে অধঃপতিত হয়ে বুর্জোয়া পার্টির নেতা হওয়া বা তাদের আশ্রয়ে ক্রিমিনাল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। শিমূলের ঘটনাটা সেরকমই একটা। কিন্তু ডিবি-নেতা বা বুর্জোয়া মিডিয়া এই আওয়ামী পরিবারের ক্রিমিনালকে এখন বানিয়েছে মাওবাদী নেতা। বলছে চরমপন্থি। অথচ, যে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা পুলিশ উপরোক্ত ধরনের বহু বহু অপরাধের হোতা তাদেরকে কখনো তারা চরমপন্থি বলে না। আনারও চরমপন্থি নয়, নির্বাচিত এমপি, জনপ্রিয় নেতা। শেখ হাসিনাকেও তারা চরমপন্থি নেতা বলে না। কারণ, তারা রাতের বাহিনী করে না, দিনে দুপুরে দুকান কাটার মতো করে দিনে দুপুরেই করে চলেছে। কারণ, তারা রাষ্ট্রক্ষমতায়।

এইসব জনপ্রিয় নেতা ও ক্রিমিনাল গডফাদারদের কে তৈরি করে আর কে রক্ষা করে?

উপজেলা নির্বাচন

কেমন হলো উপজেলা নির্বাচন? সিইসি বলেছেন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে তিনি “খুবই সন্তুষ্ট”। সন্তুষ্ট হবারই কথা। কারণ, দু’একটি বাদে সবই আওয়ামী লীগ। যে কয়জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন, বোমা গুলি ফুটেছে সেসব হয়েই থাকে। তবু তো ৩৫/৪০ ভাগ ভোট পড়েছে। কম কী? প্রধানমন্ত্রী যদি প্রতীক বাদ দেয়ার ঐ বুদ্ধিটা বের না করতেন তাহলে তো......। অবশ্য পত্রিকা টিভির ছবিতে দেখা গেছে কেন্দ্রগুলোতে ভোটার নেই। খা খা খালি মাঠ। তাতে কী? হিসেবে তো ৩৮%। বিরাট সফলতা। জনগণ ভোট দিয়েছেন বলেই না আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়! ঠিক না?

শেখ হাসিনা বুর্জোয়া ব্যবস্থাটির যে ক্ষতি করেছেন তা সুদীর্ঘ ৫ দশকে বিপ্লবীরাও করতে পারেন নি। তিনি সমগ্র বুর্জোয়া নির্বাচনি ব্যবস্থাটিকেই ধ্বংস করে ফেলেছেন। ভালো। এটা খারাপ নয়। খারাপ হলো জনগণ কী করবেন তাহলে? চলবে এভাবেই? জনগণকে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আন্দোলনের পথে যেতে হবে। নির্বাচন দাবি কোনো পথ নয়। ফ্যাসিবাদের অবসানে শ্রমিক-কৃষক-জনতার একটি গণসরকার গঠনের বিপ্লবী পথেই এগোতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত ও চীন সফর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চীন সফরে দাওয়াত দিয়েছে– ৯ জুলাই। চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এটা ‘গেমচেঞ্জার’ সফর হবে। হুমকিটা কি ভারতের বিরুদ্ধে, নাকি আমেরিকার? হয়তো দুটোই। হাসিনা-আওয়ামী লীগের তো উপায় নেই। চীনের সাথে খাতির করতেই হবে। আমেরিকা তাকে চাপে রেখেছে। আর্থিক সংকটে আইএমএফ অল্প কিছু টাকা দিয়েছে বটে। কিন্তু সেজন্য যেসব শর্ত হাসিনাকে হজম করতে হয়েছে তাতে তার নাভিশ্বাস। যদিও ভারত তার ক্ষমতার মূল বৈদেশিক উৎস, কিন্তু ভারতের সামর্থ্য নেই হাসিনা সরকারের আর্থিক সংকট সেভাবে সামাল দেয়ার। তাই, তাকে চীনা তহবিলের জন্য ছুটতেই হবে। আর আমেরিকার চাপ সহ্য করতে হলে এখন তার চীন সাপোর্ট প্রয়োজন বটে। এটা দিয়ে আবার আমেরিকার সাথে দরাদরিটাও চলে।

চীনও খেলছে। এ অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব কমানোর জন্য বাংলাদেশ তার জন্য খুব দরকার। পদ্মা সেতু তারা করে দিয়েছে। হাসিনার মান রক্ষা করেছে। এখন আর্থিক খাতের দুর্গতি নাশে হাসিনার পাশে থাকলে বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলার সুযোগ রয়েছে।

কিন্তু তাহলে ভারত? তার কী হবে? সে-ই তো হাসিনার আসল প্রভু। তাকে না বলে চীনে গেলে চলে? তাই, ভারতের ভোট হতে না হতে, নতুন সরকার বানাতে না বানাতে সেখানে সফরের দিন কাল প্রায় ঠিক। চীন সফরের আগেই সম্ভবত ২১ জুন প্রধানমন্ত্রী ভারতে যাচ্ছেন বলে অনুমিত হচ্ছে। অবশ্য তার আগেই মোদি-উৎসবে দাওয়াত রয়েছে।

এসব সফরকে নিছক বন্ধুত্ব ও অর্থনৈতিক লেন-দেন ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এ হলো প্রভুদের কাছে দালালদের ছুটোছুটি। হাসিনা-আওয়ামী সংকট এতে বাড়বে বৈ কমবে না। আমেরিকা বসে বসে আঙুল চুষবে না। ভারতও চীন-মাখামাখি বাঁকা চোখেই দেখবে। তিস্তা ব্যারেজের চীনা প্রস্তাব হাসিনা করবেন না, খবরদার, ভারত কিন্তু সহ্য করবে না। বেশি আগালে খবর আছে। 

আবারো বাজেট, আবারো ... ...

চলমান ব্যবস্থায় প্রতিবছর সরকার একটি করে বাজেট দেয়। এটা হলো বিগত বছরে নিজেদের আয় ব্যয়ের হিসেব ও আগামী বছরের সম্ভাব্য হিসেব। এতে জনগণের বিশেষ কোনো আগ্রহ থাকার বিষয় নেই। তবে বুর্জোয়া মিডিয়া এটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কারণ এটা তাদের জন্য বড় এক বিষয়। বিশেষত ব্যবসায়ী শিল্পপতি এদের জন্য। তাদের নিজেদেরও লাভ-ক্ষতির হিসেব। জনগণের বিবেচনার দিক হলো কোন নিত্য পণ্যগুলোর দাম বাড়বে তা জানা। যদিও বাজেটকে তোয়াক্কা না করেই সারা বছর ধরেই জনগণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বাড়ানো হয়।

এবারও প্রচলিত নিয়মে কিছু জিনিষের দাম বাড়বে। কিন্তু জনগণের জন্য বর্তমানের বড় মাথা ব্যথার কারণ হলো, জ্বালানিতে বরাদ্দ কম রাখা হয়েছে। অথচ নিয়মিতভাবে বাড়বে গ্যাস-বিদ্যাুতের দাম। যার ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদনের খরচ বাড়বে। ফোনের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে শাসকশ্রেণির লোকদের জন্য লক্ষ লক্ষ কোটি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দান থাকছে।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছরই বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন দাবি করে থাকে। কিন্তু তা বিশ্বমানের চেয়ে বহু নিচে থাকে। অন্যদিকে আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনী– যারা আসলে জনগণের কোনো কাজ করে না, জনগণের টাকা তাদের জন্যই বিরাটভাবে বরাদ্দ করা হয়। বর্তমান বাজেট বাস্তবায়নের জন্য দাতা সংস্থাগুলোর কাছে ২০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সুতরাং এই বাজেটও সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর থাকছে।

আমাদের দেশে বর্তমানে যে হাসিনাতন্ত্র চলছে, তাতে এমনকি তাদের নিজেদের বাজেট নিয়েও তারা সংসদে খুব কমই আলোচনা করে। প্রায় বিনাতর্কেই সব পাশ হয়ে যায়। সংসদ হলো শুধু সিল মারার হাতিয়ার। সাংসদদের বেতন ভাতা সুযোগ সুবিধা ভালোই থাকবে। যদিও এসব লক্ষ টাকার বেতনে তাদের কিছুই যায় আসে না। তাদের মূল আয় যে কী সেটা এমপি আনার ভালোই জানতো।

তথাপি বাজেটের সূত্র ধরে যে আলোচনা ও প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি হয় তাকে কাজে লাগানো উচিত। বাজেটের উন্মোচন প্রয়োজন। একইসাথে জনগণের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, অন্যায় কর বাতিল করণ– এসব বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

কেএনএফ– পাহাড়ে নতুন তৎপরতা

কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় কেএনএফ (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) নামের সংগঠনটির তৎপরতা জাতীয় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। অবশ্য সংগঠনটি একেবারে নতুন এমন নয়। বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক কাজের মধ্য দিয়ে তারা বেশ কিছু বছর আগে থেকেই কাজ করছিল। কিন্তু বছর দুই আগে প্রথম তাদের নাম মিডিয়ায় উঠে আসে তাদের সশস্ত্র কার্যক্রমের সূত্র ধরে। একটি মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন ‘হিন্দাল’ গোষ্ঠীর জঙ্গিদেরকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল বলে সরকারি সংস্থাগুলো দাবি করে। সেখানে অভিযান চালিয়ে কিছু জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। তবে মূল কেএনএফ সংগঠনটি তাদের ঘাঁটি ছেড়ে পাহাড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় থেকেই তাদের সশস্ত্র তৎপরতা, তাদের প্রধান নেতা নাথান বম এবং তাদের কর্মসূচি ইত্যাদি নিয়ে কিছু আলোচনা দেখা যায়।

তখন শোনা যায় তাদের সাথে সরকারের একটি শান্তি-আলোচনা চলছে। কিন্তু হঠাৎ করেই তারা এ বছরের প্রথমদিকে বান্দরবান জেলার একটি ব্যাংকে হামলা করে। সরকারি সূত্র বলছে যে, কয়েক শ’ সশস্ত্র ব্যক্তি ব্যাংকটিতে হামলা করে, সেখানকার পাহারায় রত আনসার/পুলিশদের ১৪টি অস্ত্র দখল করে নেয় এবং ব্যাংকটির ম্যানেজারকে অপহরণ করে। পরে জানা যায় যে, বড় অঙ্কের মুক্তিপণ নিয়ে তাকে তারা ছেড়ে দেয়, যদিও এ বিষয়ে সরকারি পক্ষ গোপনীয়তা রক্ষা করে।

তাদের ঘোষিত কর্মসূচিতে দেখা যায় যে, তারা তাদের অঞ্চলটিকে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল করার দাবিতে সংগ্রাম করছে। এ সংগঠনে রয়েছে, তাদের দাবি মতো, ৬টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ১৩টি জাতিসত্তার সবচেয়ে সংখ্যালঘু অংশ। এর আগে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন বা এমনকি স্বাধীনতার জন্য সেখানে সংগ্রাম করেছে যে সংগঠন- “জনসংহতি সমিতি”, তাতে প্রাধান্য ছিল চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জাতিসত্তার নেতৃত্বদের। পরে এ সংগঠন কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হলেও সবগুলোতেই ঘুরে ফিরে মূলত এ তিনটি জাতিসত্তারই কর্তৃত্ব রয়েছে। ফলে এদের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ধারা হিসেবে কেএনএফ নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

কেউ বলতে চায় যে, পাহাড়ি জনগণের জাতিগত সংগ্রামে ভাঙন সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র এদের তৈরি করেছে। আবার এখন কোনো কোনো বুর্জোয়া বিশ্লেষকের মতে ভারত এদের দিয়ে এবং এদের সাথে ভারতের কুকি-চীনদের একত্র করে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পাঁয়তারা করছে, যে রাষ্ট্রটি হবে ভারতেরই একটি বাফার স্টেট। যেটি কিনা মিয়ানমারের চীনাপন্থি শক্তিগুলোর বিপক্ষে ভারতের নিরাপত্তায় একটি দেয়াল হিসেবে কাজ করবে। 

কিন্তু এসব জল্পনা যা-ই হোক না কেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যকে ফেলে দেয়া যাবে না। তিনি স্পষ্টতই মার্কিনকে ইঙ্গিত করে বলেছেন যে, তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু খ্রিষ্টান শক্তির সমন্বয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করছে। প্রসঙ্গত কুকিরা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। মিয়ানমারের চীন প্রদেশটি এখন কার্যত সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত এবং সেখানে এই জাতিসত্তার জনগণের মুক্ত এলাকা গঠিত হয়েছে। আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ যে, গত বছর ভারতের মনিপুরে কুকিদের বিরুদ্ধে একটি বড় জাতিগত দাঙ্গা বাধানো হয়েছিল, যাতে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বিজেপি’র বড় হাত ও ইন্ধন ছিল বলে প্রচার রয়েছে। তাই, সেখানকার নিপীড়িত কুকিরা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর কুকিদের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় করতেই পারেন। কেএনএফ-এর বাহিনীও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিযানে ভারত বা অন্য কোথাও চলে যায় বা গিয়েছে বলেও বলা হয়ে থাকে।

সুতরাং বিষয়টা এখানকার খুবই সংখ্যালঘু কুকিদের একটি ছোট তৎপরতা নয় বলেই মনে হয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে এবং ভারত ও মিয়ানমারের সন্নিহিত অঞ্চলে এখন বিশেষ টালমাটাল অবস্থা চলছে। এখানে বিশ্ব ও আঞ্চলিক প্রভুত্ব ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলো খুবই সক্রিয়। তাই, কেএনএফ-তৎপরতা খুবই মনোযোগ দাবি করে। একই সাথে এখানকার জাতিগত আন্দোলনগুলোর রয়েছে ন্যায্যতা, যা বিবিধ শক্তিকে সেখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি করে দেয়। যত ছোটই হোক, প্রত্যেক জাতিসত্তার অধিকার রয়েছে স্বায়ত্তশাসনের। তবে সে আন্দোলন তখনই সফলতার দিকে এগোতে পারে যদি তা বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ বিরোধী নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাথে মৈত্রী গঠন করে। তা না হলে তাদের পক্ষে ঐ শত্রুপক্ষগুলোর হাতিয়ার হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকবেই। কেএনএফ কোন পথে এগুচ্ছে তা আগামীতে আরো স্পষ্ট হবে নিশ্চয়ই।

আরও খবর
 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র