পদ্মা সেতু এবং পরিবহণ ব্যবস্থা
উপরের ছবিটি পদ্মা সেতুর নয়- সবাই জানেন। কিন্তু এ ছবির মতো অসংখ্য সেতু দেশের সর্বত্র গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। এমনকি শহর-নগরেও এটা দুষ্প্রাপ্য নয়। বাঁশের ‘হাক্কা’ ছাড়াও আধুনিক কালভার্টে ওঠার জন্য মই বা পৃথক সিড়ি, অথবা সেতুর নিচ দিয়ে পথÑ এসব কোনো অস্বাভাবিক দৃশ্য নয়। ভাঙ্গা-চোরা রাস্তা-ঘাট, যানজট, গাড়ী-ঘোড়ার নৈরাজ্যিক চলাচল, কমপিটিশন, দুর্ঘটনা..... এসব দেশের পরিবহণ ব্যবস্থার নিত্যচিত্র। এর মাঝে পদ্মা সেতু- ‘বিস্ময়কর’! এ যেন এক দেশ, দুই জগৎ। একদিকে গুলশান, অন্যদিকে কড়াইল বস্তি; একদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদসদৃশ ভবন ও বাসস্থান, অন্যদিকে বুড়িগঙ্গা তীরের বাঁশের বস্তি। বাস্তবে এটা দুই শ্রেণির জন্য শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি ও রাষ্ট্রের দুই ব্যবস্থা। ‘উন্নয়নে’র দুই প্রকাশ, দুই ফলাফল।
যেদিনটায় পদ্মা সেতু উদ্বোধনের বিলাসিতায় দেশ ভেসেছে, তার আগের প্রায় কয়েক সপ্তাহ ধরে বৃহত্তর সিলেট ও রংপুর অঞ্চলে বন্যায় লক্ষ-কোটি জনগণ ভেসেছেন অশুভ অনাকাঙ্খিত পানির তোড়ে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর মনে হয়েছে এ অবস্থায় পদ্মা সেতুর উৎসবটি খুবই অমানবিক হয়ে যাবে। তাই তিনি বিমানে চড়ে বহু উপর থেকে বন্যা-প্লাবিত হাওরের অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন। কিন্তু তাতে বন্যার্ত মানুষের অপরিসীম কষ্ট কিছুই লাঘব হয়নি। শেষে এসে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, হাওরে আর রাস্তা নির্মাণ করা হবে না। এমন কি তিনি প্রয়োজনে রাস্তা ও বাঁধ কেটে দিতে বলেছেন। যাতে বন্যার পানি নেমে যেতে পারে। তার নির্দেশ/পরামর্শ কেউ মেনেছে বলে জানা যায় নি। কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টির পঞ্চাশ বছর পরে এসে প্রকৃতির এক প্রতিশোধমূলক আঘাতের মুখে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দিলেন সেটা পদ্মাসেতু প্রকল্প-এলাকায় বিপরীত কেন হচ্ছে তার জবাব কোথাও নেই। কেন একটি ছোটো দেশের এক এলাকায় পরিবহণের ক্ষেত্রে পঞ্চাশ বছরে নির্মিত রাস্তাগুলোও কেটে ফেলতে হবে, আর কেনই বা অন্য একটি এলাকায় রাস্তা-সড়ককে এতোই প্রাধান্য দেয়া হবে যে, সেখানে পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ এক প্রকল্প খাড়া করে তাতে দেশবাসীকে মুগ্ধ করে রাখা হবে?
পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারি ও আওয়ামী প্রচার, এমনকি সাম্রাজ্যবাদী-সম্প্রসারণবাদী তেলবাজি পিঠচাপড়ানির সারাংশ হলো-
এটা বাঙালির, বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার প্রতীক, কারণ, এটা দেশের টাকায় নিজের টাকায় করা। এটা শেখ হাসিনার নামে দুর্নীতির অপবাদ দেবার এক দাঁতভাঙ্গা জবাব।
মধ্যবিত্তের বা আমজনতার এতো কিছুর দরকার নেই। তারা ৬ ঘণ্টার জায়গায় ৩ ঘণ্টায় বরিশাল যাবে এতেই তাদের গদগদ ভাব। পৃথিবীর আর কিছু তো দরকার নেই!
যাহোক, আমরা খুব তৃপ্ত। এক পৃথিবী শ্রেষ্ঠ জাতির মহান নেত্রী আমাদেরকে বিশ্বের সুউচ্চ চ‚ড়ায় তুলে দিয়েছেন। সারা দুনিয়ায় এর চেয়ে সেরা আর কী আছে?
বিপরীতধর্মী কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। কারণ, আওয়ামী বুর্জোয়ারা হুক্কা-হুয়া প্রচারে যেমন সিদ্ধহস্ত, তেমনি মধ্যবিত্ত জনগণ আশু কিছু সুবিধা আর উগ্র জাতীয়তাবাদের কুপ্রভাবে যুক্তি-তর্ক, সত্য ও বাস্তবতাকে ভুলে যেতে অভ্যস্ত।
প্রথমত, দেশের টাকায় হোক আর বিদেশি ঋণে হোক, তাতে জনগণের আর্থিক দিকে পার্থক্য কী হলো? জনগণ এ সেতু বানানোর জন্য টাকা একবার দিয়েই দিয়েছেন। তাহলে তারা এ সেতু পার হতে এখন আবারো টাকা দেবেন কেন? (টোল) শুধু তাই নয়, সে খরচ আবার পূর্বের ফেরির খরচের চেয়ে বেশি।
এটা নিজের টাকায় করা এর অর্থ কি এটা যে, যে-প্রকল্পগুলো বিদেশি ঋণে করা হয় সেগুলো বিদেশিরা মাগনা করে দেয়? সে টাকাও তো জনগণকে সুদে-আসলে শোধ করতে হয়। সেগুলোও শেষপর্যন্ত জনগণের টাকাতেই করা। নয় কি?
আবার বলা হচ্ছে নিজ টাকায় পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প প্রমাণ করেছে ‘আমরাও পারি’। তাহলে এটা করার জন্য আগে এই আওয়ামী সরকারই কেন বিশ্বব্যাংকের মতো এক কুখ্যাত দুর্নীতিবাজ ষড়যন্ত্রকারী সুদখোর সাম্রাজ্যবাদী সংস্থার কাছে হাত পেতেছিল? কমিশনের জন্য?
নিজেরাই যদি পারো, তাহলে আরো যত সব বৃহৎ প্রকল্প চলছে- যেমন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেল, রূপপুর বিদ্যুৎ, মাতারবাড়ি, পায়রা, রামপাল, এক্সপ্রেস ওয়ে- এসব কেন বিদেশি ঋণে করা হচ্ছে? এতোসব প্রকল্প সবই বিদেশি ঋণে করে একটি মাত্র প্রকল্প জনগণের টাকায় বানিয়ে ফুটানি দেখাচ্ছো কেন? যখন কিনা জনগণের জরুরি দরকার হচ্ছে বন্যা-কবলিত অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি এবং স্থায়ী নিরাপত্তা। যখন কিনা দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত দরিদ্র মানুষের প্রয়োজন আর্থিক ও খাদ্য নিরাপত্তা। যখন কিনা প্রয়োজন জ্বালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, সার... ...।
আচ্ছা, এতেও কথা আছে। পদ্মা সেতু নিজ টাকায় হচ্ছে এটা কি সত্য? পদ্মা সেতু হলো সড়ক ও রেল সেতুর মিলিত প্রকল্প। যার অর্ধেকটা হয়েছে, রেলটা সেরকম ভাবে এখনো ধরাই হয়নি। যার প্রায় সব অর্থই চীন থেকে ধার করা হচ্ছে। তাহলে এটা কেন বলা হচ্ছে না যে, অর্ধেক সেতু নিজ টাকায়? বাকীটা বিদেশি? এটা কি সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভরতা নয়?
যে কৃতিত্ব ফলানো হচ্ছে যে, নিজেরাই পদ্মা সেতু করা হয়েছে সেটাও মিথ্যা। সেতুটি করাই হয়েছে চীনের কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এটা কি বিদেশ-নির্ভরতার বড় প্রমাণ নয়?
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানদণ্ডে একটি বড় সেতু নিশ্চয়ই- ৬ কিলোমিটার। কিন্তু বিশ্ব মানদণ্ডে এটা খুবই নগণ্য। এর বহু গুণ দীর্ঘ সেতু রয়েছে পৃথিবীতে অনেক।
বাংলাদেশেই যমুনা সেতুটিও কম দীর্ঘ নয়, যার পেছনে আওয়ামী অবদান খুবই নগণ্য। যেটা ১৫ বছর আগেই চালু হয়েছে। সেরকমই আরেকটি সেতু নির্মাণের মধ্যে কী এমন বাহাদুরি রয়েছে?
পদ্মার মতো খরস্রোতা নদীর উপর সেতুর বাহাদুরি নিতে হলে হার্ডিঞ্জ সেতুর জন্য ব্রিটিশদেরকেই দিতে হবে। একশ’ বছর আগে সেটা তারা করেছিল নিজেদের বাণিজ্য-স্বার্থে। যখন পদ্মা ছিল আরো খরস্রোতা এবং প্রযুক্তিগত ভাবে তখন সারা বিশ্ব ছিল অনেক পিছিয়ে। কিন্তু সেই ব্রিটিশকেও জনগণ খেদিয়ে দিয়েছিল তাদের বর্বর নিপীড়ন ও শোষণের কারণে।
সুতরাং কোন দিক দিয়ে এটা অনন্য? দুটো দিক বলা যেতে পারে। এক, এর বাজেট শুরু হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে, আর শেষ হলো ৩০ হাজার কোটি টাকায়! দুই, এটা বানাতে লেগে গেলো দীর্ঘ ১২ বছর। বিশ্ব ব্যাংকের ফাঁড়ার কারণে দুই বছর বাদ দিলেও এজন্য ১০ বছর আজকের বিশ্ব মানদণ্ডে একটি রেকর্ড।
দুর্নীতি ছাড়া নির্মাণ-খরচ তিনগুণ বেড়ে যাবার আর কী কারণ থাকতে পারে? সেতুর দুই পাশের সংযোগ সড়ক নির্মাণে খরচ হয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ মাত্রায়। দুর্নীতি খুঁজতে কি বিশ্বব্যাংক বা কানাডায় যেতে হবে?
এসব ক‚টক্যাচাল বাদ দিয়ে আসা যাক পরিবহণ ব্যবস্থার আলোচনায়, যার কিছুটা ইঙ্গিত আগেই দেয়া হয়েছে।
* পদ্মাসেতু দিয়ে ৩ ঘণ্টায় বরিশাল আর ৫ ঘণ্টায় কুয়াকাটা যেতে পেরে কিছু মধ্যবিত্ত খুব খুশি। দেশ যে কত এগিয়ে গেছে!
ষাট-সত্তর দশকে ঢাকা শহরে মীরপুর থেকে গুলিস্তান সাইকেলে যেতে ১ ঘণ্টার কম সময় লাগতো। এখন পরিবহণে ‘প্রভ‚ত উন্নয়নে’র পর বাসে যেতে ২/৩ ঘণ্টাও লাগে। পাঠকদের কেউ কি বিগত কয়েক বছরের ‘উন্নয়ন’ কালে গুলিস্তান থেকে গাজীপুর গিয়েছেন? ৩/৪ ঘণ্টা মামুলি। আরো বেশি হলেও আশ্চর্যের নয়।
যমুনা সেতু হবার পরও টাঙ্গাইল রুটে যানজটের “উন্নয়ন” উত্তরাঞ্চলের জনগণ ভালোভাবেই টের পান। এবার ঈদেও পেয়েছেন।
তো, এই যদি হয় পরিবহণে এ জাতীয় উন্নয়নের ফল, তাহলে এ নিয়ে যে আহ্লাদের কিছু নেই সেটা বলেই দেয়া যায়।
আসলে বিষয়টা হলো, এসব উন্নয়ন হয় ভিন্ন কারণে, অন্য কারও স্বার্থে, জনগণের নয়। যেমনটা হয়েছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ক্ষেত্রে। তাতে কলকাতা থেকে দার্জিলিং যাওয়া জমিদারদের জন্য নিশ্চয়ই সহজ হয়েছিল। আর ব্রিটিশদের বাণিজ্য-স্বার্থ তো সবার উপরে।
তারপরও প্রশ্ন থাকে এক ধরনের উন্নয়ন-তো হচ্ছে বটে। তাই না? উন্নয়নটা হয়ে গেলে কম সময় লাগবে। ঝামেলা ছাড়া চলাচল করা যাবে। গ্রামের সবজি/কৃষি উৎপাদন দ্রুত ঢাকায় আসবে, ফলে কৃষকরা পয়সা পাবে। ওদিকে শিল্প-কারখানা হবে, জনগণের ভাগ্য খুলবে। ভালো তো।
কিন্তু কিছুটা গভীরে চিন্তা করা যাক।
নদী পথে অনুন্নয়নের এতো অবহেলা সত্তে¡ও এখনো স্টিমারে বরিশাল যেতে ৫/৬ ঘণ্টা লাগে। তাহলে মাত্র ২/৩ ঘণ্টা কমানোর জন্য এতো বিপুল অর্থ কেন ব্যয় করবে বাংলাদেশ? একটা গবেষণা বলছে, সড়কপথে শুধু যানজটের কারণেই বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো জ্বালানি খরচ বেশি হয় দেশের। তাহলে কেন জ্বালানি-খরচের আরো বর্ধিত-ব্যবস্থা করা হবে এ ধরনের পরিবহণ ব্যবস্থাকে বাড়িয়ে তুলে? গবেষণা আরো বলছে, সড়ক-দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ৭/৮ হাজার লোক মারা যাচ্ছেন, প্রায় ৫০ হাজার হচ্ছেন আহত, যাদের বড় একটি অংশ সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। এই পরিবহণ ব্যবস্থা বায়ুদূষণের একটা বড় কারণ। বিদেশের উপর জ্বালানি তেল ও গ্যাস নির্ভরতার এক বড় কারণ।
এরকম বৃহৎ সেতুর কারণে গ্রাম থেকে দলে দলে শ্রমজীবী মানুষ ঢাকায় এসে ভীড় করছেন। ঢাকা হয়ে পড়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুষিত বাতাসের শহর, সবচেয়ে খারাপ বসবাসযোগ্য একটি শহর। পদ্মাসেতুতে যারা আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সেই মধ্যবিত্তরা কয়েক বছরের মধ্যে টের পাবেন তাদের প্রিয় ঢাকায় তারা আর চলাচল করতে পারছেন না। যেখানে মফস্বলকে বা গ্রামকে ভিত্তি করে উন্নয়ন হতে হবে সেখানে সব কিছু রাজধানীকে কেন্দ্র করে চলার এক ভয়াবহ উন্নয়ন ধারায় দেশকে নিয়ে চলেছে সাম্রাজ্যবাদ। আর তাতে সানন্দে সায় দিচ্ছে তাদের দালাল বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি ও তাদের রাষ্ট্র, বিশেষত আওয়ামী সরকার।
পদ্মা সেতুর যে প্রকৃত গণবিরোধী, দেশবিরোধী ও বুর্জোয়া স্বার্থানুসারী অবদান তাহলো নৌ-পরিবহণকে হত্যা করা। নদী-খাল-বিল ধ্বংস করে ইতিমধ্যেই তাকে মুমূর্ষু করে ফেলা হয়েছে। পদ্মাসেতু সেই কফিনে এক বড় পেরেক মাত্র।
দক্ষিণাঞ্চলে যে ঐতিহ্যবাহী নৌ-পরিবহণ ব্যবস্থা এখনো টিম টিম করে জ্বলছিল তাকে ধ্বংসের পথে আরো এগিয়ে নিলো পদ্মাসেতু।
পরিবহণে উন্নয়ন যে দরকার নেই তা নয়। বরিশালে যদি ৩ ঘণ্টায় যাওয়া যায় তাহলে সেটা ভালো বটে। কিন্তু সেটা সবার সর্বদা দরকার নেই। আর নৌ-পরিবহণে কি সেটা অনেকটাই সম্ভব ছিল না? তার উন্নয়নের জন্য কী করা হয়েছে? তাকে উন্নত করলে এবং জনবান্ধব ব্যবস্থা থাকলে শুধু ৩ ঘণ্টায় বরিশাল যাওয়াই যে সম্ভব তা নয়, সেটা হতো অনেক বেশি নিরাপদ, অনেক বেশি পরিবেশ-বান্ধব, অনেক বেশি আরামদায়ক, অনেক বেশি অর্থ-সাশ্রয়ী।
সর্বোপরি, সড়ক পরিবহণের যে ধারাটিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে সেটি তার সকল ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভরতাকে বাড়িয়ে তুলছে। পদ্মা-সেতু যে তার ব্যতিক্রম নয় সেটা উপরেই দেখানো হয়েছে। এতে সাম্রাজ্যবাদের সাথে লাভবান হচ্ছে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি- প্রথমত, শাসকশ্রেণি রাষ্ট্র ও সরকারের কমিশন ভোগীরা, দ্বিতীয়ত পরিবহণ মালিকরা। ইতিমধ্যেই ১ হাজারের মতো বাস নতুন করে রাস্তায় নেমেছে। বাইককে আপাতত নিষিদ্ধ করা হলেও তাকেও ছাড়তে হবে। সাম্রাজ্যবাদীরা ও আমদানিকারকরা আরো লক্ষ লক্ষ বাইক-কার-বাস-ট্রাক-কার্গো এনে দেশের সড়কগুলো ভরে ফেলবে, ভরে ফেলবে ঢাকার রাস্তাগুলো। ফলে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের উপর পড়বে এক বড় ধরনের চাপ। ইতিমধ্যেই লোডশেডিং-এর জ্বালায় মধ্যবিত্তরা, এমনকি শিল্প-মালিকরাও কিছুটা মাত্র টের পাওয়া শুরু করেছেন।
বাংলাদেশ-পরিবহণে সাম্রাজ্যবাদী উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো, ঐতিহ্যবাহী নৌ-পরিবহণকে ধ্বংস করে দেয়া, এমনকি প্রয়োজনে রেলকেও নস্ট করা, এবং জায়গায় বেজায়গায় সড়ক নির্মাণ করা, বড় বড় সেতু তৈরি করা এবং সড়ক-যান নির্ভর করে গড়ে তোলা। এর পরিণতি হলো ছোটো এই দেশের বিপুল পরিমাণ কৃষি-জমি সড়ক নির্মাণে খেয়ে ফেলা, অর্থ ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর হয়ে পড়া, সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর ও সাম্রাজ্যবাদ-পরিকল্পিত শিল্প গড়ে তোলা, তার স্বার্থে দেশের গ্যাস পানি ভূমি বাতাস সম্পদ খেয়ে ফেলা, বিদেশ থেকে গাড়ী ও বাইক আমদানি এবং প্রচুর সড়ক দুর্ঘটনার কারণ তৈরি করা। পদ্মা সেতু সেটাই আরো বাড়াবে।
বড় বড় সেতু, দ্রুত যাতায়াত যে প্রয়োজন নয় তা নয়। কিন্তু প্রথমত, পরিবহণের দেশ-জনগণ-পরিবেশ বান্ধব ধারাকে ভিত্তি করে সেটা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের অর্থনীতি ও সমাজ-উন্নয়নে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। আমাদের দেশে এখন ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে (সড়ক ও রেলসহ) পদ্মা সেতু অপরিহার্য নয়। অপরিহার্য হলো, প্রতিটি মহাসড়কে এবং নগরগুলোর প্রতিটি বড়ো সড়কে অযান্ত্রিক বা ছোটো যানবাহন চলাচলের জন্য পৃথক লেন নির্মাণ করা। রাস্তাগুলোকে সাইকেল জাতীয় অযান্ত্রিক বাহনের উপযোগী করে বিপুল সাইকেল-শিল্প গড়ে তোলা। নৌ-পথকে উন্নত করার জন্য খাল-বিল-নদী ধ্বংসকে রুখে দিয়ে নাব্যতা বৃদ্ধি করা। নৌ-পরিবহণকে আধুনিকীকরণ করা, দেশজ প্রযুক্তি-নির্ভর করা ও তার উন্নয়ন সাধন করা।
এছাড়া এখনই দরকার ৫ হাজার ইউনিয়নে উন্নত হাসপাতাল তৈরি করা। প্রতি বিভাগে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। প্রতিটি জেলায় বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা। সৌর-বিদ্যুৎ, জৈব বিদ্যুৎ ইত্যাদির বিপুল ব্যবস্থা করা, যাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভর করতে না হয়। দরকার হলো রাজধানীতে ও নগরগুলোতে মানুষের ঢল বন্ধ করে গ্রামাঞ্চল ও মফস্বলকে উন্নয়নের ভিত্তি করা। সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর শিল্প-উন্নয়ন থেকে বেরিয়ে আসা। এবং আরো বহু কিছু।
বিদেশ-নির্ভর, পরিবেশ ধ্বংসকারী ও জমি-পানি-গ্যাসসহ দেশজ সম্পদ শুষে নেয়া উন্নয়নকে বাতিল করে কৃষিকে ভিত্তি করে ও কৃষি-নির্ভর শিল্প গড়ে তোলায় মনোযোগী হওয়া।
এই রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণি সেপথে যাবে না এবং যেতে পারেও না। তাদের অগ্রাধিকার হলো বিদেশিদের পরিকল্পনায় তাদেরই স্বার্থের বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়া, যাতে তারা নিজেরা তার থেকে কমিশন খেয়ে, দুর্নীতি করে, নিজেরাও বড় অর্থের মালিক বনতে পারে, এবং সেই অর্থ তারা কানাডাসহ বিদেশে পাচার করতে পারে। এই দেশ তাদের নয়। এখানে তারা লুটপাট করে এবং টাকা কামাই-এর উর্বর-অঞ্চল হিসেবে ব্যবহার করে মাত্র।
এদের কবল থেকে না বেরুলে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন কখনই হবে না।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
পদ্মা সেতু এবং পরিবহণ ব্যবস্থা
উপরের ছবিটি পদ্মা সেতুর নয়- সবাই জানেন। কিন্তু এ ছবির মতো অসংখ্য সেতু দেশের সর্বত্র গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। এমনকি শহর-নগরেও এটা দুষ্প্রাপ্য নয়। বাঁশের ‘হাক্কা’ ছাড়াও আধুনিক কালভার্টে ওঠার জন্য মই বা পৃথক সিড়ি, অথবা সেতুর নিচ দিয়ে পথÑ এসব কোনো অস্বাভাবিক দৃশ্য নয়। ভাঙ্গা-চোরা রাস্তা-ঘাট, যানজট, গাড়ী-ঘোড়ার নৈরাজ্যিক চলাচল, কমপিটিশন, দুর্ঘটনা..... এসব দেশের পরিবহণ ব্যবস্থার নিত্যচিত্র। এর মাঝে পদ্মা সেতু- ‘বিস্ময়কর’! এ যেন এক দেশ, দুই জগৎ। একদিকে গুলশান, অন্যদিকে কড়াইল বস্তি; একদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদসদৃশ ভবন ও বাসস্থান, অন্যদিকে বুড়িগঙ্গা তীরের বাঁশের বস্তি। বাস্তবে এটা দুই শ্রেণির জন্য শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি ও রাষ্ট্রের দুই ব্যবস্থা। ‘উন্নয়নে’র দুই প্রকাশ, দুই ফলাফল।
যেদিনটায় পদ্মা সেতু উদ্বোধনের বিলাসিতায় দেশ ভেসেছে, তার আগের প্রায় কয়েক সপ্তাহ ধরে বৃহত্তর সিলেট ও রংপুর অঞ্চলে বন্যায় লক্ষ-কোটি জনগণ ভেসেছেন অশুভ অনাকাঙ্খিত পানির তোড়ে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর মনে হয়েছে এ অবস্থায় পদ্মা সেতুর উৎসবটি খুবই অমানবিক হয়ে যাবে। তাই তিনি বিমানে চড়ে বহু উপর থেকে বন্যা-প্লাবিত হাওরের অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন। কিন্তু তাতে বন্যার্ত মানুষের অপরিসীম কষ্ট কিছুই লাঘব হয়নি। শেষে এসে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, হাওরে আর রাস্তা নির্মাণ করা হবে না। এমন কি তিনি প্রয়োজনে রাস্তা ও বাঁধ কেটে দিতে বলেছেন। যাতে বন্যার পানি নেমে যেতে পারে। তার নির্দেশ/পরামর্শ কেউ মেনেছে বলে জানা যায় নি। কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টির পঞ্চাশ বছর পরে এসে প্রকৃতির এক প্রতিশোধমূলক আঘাতের মুখে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দিলেন সেটা পদ্মাসেতু প্রকল্প-এলাকায় বিপরীত কেন হচ্ছে তার জবাব কোথাও নেই। কেন একটি ছোটো দেশের এক এলাকায় পরিবহণের ক্ষেত্রে পঞ্চাশ বছরে নির্মিত রাস্তাগুলোও কেটে ফেলতে হবে, আর কেনই বা অন্য একটি এলাকায় রাস্তা-সড়ককে এতোই প্রাধান্য দেয়া হবে যে, সেখানে পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ এক প্রকল্প খাড়া করে তাতে দেশবাসীকে মুগ্ধ করে রাখা হবে?
পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারি ও আওয়ামী প্রচার, এমনকি সাম্রাজ্যবাদী-সম্প্রসারণবাদী তেলবাজি পিঠচাপড়ানির সারাংশ হলো-
এটা বাঙালির, বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার প্রতীক, কারণ, এটা দেশের টাকায় নিজের টাকায় করা। এটা শেখ হাসিনার নামে দুর্নীতির অপবাদ দেবার এক দাঁতভাঙ্গা জবাব।
মধ্যবিত্তের বা আমজনতার এতো কিছুর দরকার নেই। তারা ৬ ঘণ্টার জায়গায় ৩ ঘণ্টায় বরিশাল যাবে এতেই তাদের গদগদ ভাব। পৃথিবীর আর কিছু তো দরকার নেই!
যাহোক, আমরা খুব তৃপ্ত। এক পৃথিবী শ্রেষ্ঠ জাতির মহান নেত্রী আমাদেরকে বিশ্বের সুউচ্চ চ‚ড়ায় তুলে দিয়েছেন। সারা দুনিয়ায় এর চেয়ে সেরা আর কী আছে?
বিপরীতধর্মী কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। কারণ, আওয়ামী বুর্জোয়ারা হুক্কা-হুয়া প্রচারে যেমন সিদ্ধহস্ত, তেমনি মধ্যবিত্ত জনগণ আশু কিছু সুবিধা আর উগ্র জাতীয়তাবাদের কুপ্রভাবে যুক্তি-তর্ক, সত্য ও বাস্তবতাকে ভুলে যেতে অভ্যস্ত।
প্রথমত, দেশের টাকায় হোক আর বিদেশি ঋণে হোক, তাতে জনগণের আর্থিক দিকে পার্থক্য কী হলো? জনগণ এ সেতু বানানোর জন্য টাকা একবার দিয়েই দিয়েছেন। তাহলে তারা এ সেতু পার হতে এখন আবারো টাকা দেবেন কেন? (টোল) শুধু তাই নয়, সে খরচ আবার পূর্বের ফেরির খরচের চেয়ে বেশি।
এটা নিজের টাকায় করা এর অর্থ কি এটা যে, যে-প্রকল্পগুলো বিদেশি ঋণে করা হয় সেগুলো বিদেশিরা মাগনা করে দেয়? সে টাকাও তো জনগণকে সুদে-আসলে শোধ করতে হয়। সেগুলোও শেষপর্যন্ত জনগণের টাকাতেই করা। নয় কি?
আবার বলা হচ্ছে নিজ টাকায় পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প প্রমাণ করেছে ‘আমরাও পারি’। তাহলে এটা করার জন্য আগে এই আওয়ামী সরকারই কেন বিশ্বব্যাংকের মতো এক কুখ্যাত দুর্নীতিবাজ ষড়যন্ত্রকারী সুদখোর সাম্রাজ্যবাদী সংস্থার কাছে হাত পেতেছিল? কমিশনের জন্য?
নিজেরাই যদি পারো, তাহলে আরো যত সব বৃহৎ প্রকল্প চলছে- যেমন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেল, রূপপুর বিদ্যুৎ, মাতারবাড়ি, পায়রা, রামপাল, এক্সপ্রেস ওয়ে- এসব কেন বিদেশি ঋণে করা হচ্ছে? এতোসব প্রকল্প সবই বিদেশি ঋণে করে একটি মাত্র প্রকল্প জনগণের টাকায় বানিয়ে ফুটানি দেখাচ্ছো কেন? যখন কিনা জনগণের জরুরি দরকার হচ্ছে বন্যা-কবলিত অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি এবং স্থায়ী নিরাপত্তা। যখন কিনা দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত দরিদ্র মানুষের প্রয়োজন আর্থিক ও খাদ্য নিরাপত্তা। যখন কিনা প্রয়োজন জ্বালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, সার... ...।
আচ্ছা, এতেও কথা আছে। পদ্মা সেতু নিজ টাকায় হচ্ছে এটা কি সত্য? পদ্মা সেতু হলো সড়ক ও রেল সেতুর মিলিত প্রকল্প। যার অর্ধেকটা হয়েছে, রেলটা সেরকম ভাবে এখনো ধরাই হয়নি। যার প্রায় সব অর্থই চীন থেকে ধার করা হচ্ছে। তাহলে এটা কেন বলা হচ্ছে না যে, অর্ধেক সেতু নিজ টাকায়? বাকীটা বিদেশি? এটা কি সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভরতা নয়?
যে কৃতিত্ব ফলানো হচ্ছে যে, নিজেরাই পদ্মা সেতু করা হয়েছে সেটাও মিথ্যা। সেতুটি করাই হয়েছে চীনের কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এটা কি বিদেশ-নির্ভরতার বড় প্রমাণ নয়?
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানদণ্ডে একটি বড় সেতু নিশ্চয়ই- ৬ কিলোমিটার। কিন্তু বিশ্ব মানদণ্ডে এটা খুবই নগণ্য। এর বহু গুণ দীর্ঘ সেতু রয়েছে পৃথিবীতে অনেক।
বাংলাদেশেই যমুনা সেতুটিও কম দীর্ঘ নয়, যার পেছনে আওয়ামী অবদান খুবই নগণ্য। যেটা ১৫ বছর আগেই চালু হয়েছে। সেরকমই আরেকটি সেতু নির্মাণের মধ্যে কী এমন বাহাদুরি রয়েছে?
পদ্মার মতো খরস্রোতা নদীর উপর সেতুর বাহাদুরি নিতে হলে হার্ডিঞ্জ সেতুর জন্য ব্রিটিশদেরকেই দিতে হবে। একশ’ বছর আগে সেটা তারা করেছিল নিজেদের বাণিজ্য-স্বার্থে। যখন পদ্মা ছিল আরো খরস্রোতা এবং প্রযুক্তিগত ভাবে তখন সারা বিশ্ব ছিল অনেক পিছিয়ে। কিন্তু সেই ব্রিটিশকেও জনগণ খেদিয়ে দিয়েছিল তাদের বর্বর নিপীড়ন ও শোষণের কারণে।
সুতরাং কোন দিক দিয়ে এটা অনন্য? দুটো দিক বলা যেতে পারে। এক, এর বাজেট শুরু হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে, আর শেষ হলো ৩০ হাজার কোটি টাকায়! দুই, এটা বানাতে লেগে গেলো দীর্ঘ ১২ বছর। বিশ্ব ব্যাংকের ফাঁড়ার কারণে দুই বছর বাদ দিলেও এজন্য ১০ বছর আজকের বিশ্ব মানদণ্ডে একটি রেকর্ড।
দুর্নীতি ছাড়া নির্মাণ-খরচ তিনগুণ বেড়ে যাবার আর কী কারণ থাকতে পারে? সেতুর দুই পাশের সংযোগ সড়ক নির্মাণে খরচ হয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ মাত্রায়। দুর্নীতি খুঁজতে কি বিশ্বব্যাংক বা কানাডায় যেতে হবে?
এসব ক‚টক্যাচাল বাদ দিয়ে আসা যাক পরিবহণ ব্যবস্থার আলোচনায়, যার কিছুটা ইঙ্গিত আগেই দেয়া হয়েছে।
* পদ্মাসেতু দিয়ে ৩ ঘণ্টায় বরিশাল আর ৫ ঘণ্টায় কুয়াকাটা যেতে পেরে কিছু মধ্যবিত্ত খুব খুশি। দেশ যে কত এগিয়ে গেছে!
ষাট-সত্তর দশকে ঢাকা শহরে মীরপুর থেকে গুলিস্তান সাইকেলে যেতে ১ ঘণ্টার কম সময় লাগতো। এখন পরিবহণে ‘প্রভ‚ত উন্নয়নে’র পর বাসে যেতে ২/৩ ঘণ্টাও লাগে। পাঠকদের কেউ কি বিগত কয়েক বছরের ‘উন্নয়ন’ কালে গুলিস্তান থেকে গাজীপুর গিয়েছেন? ৩/৪ ঘণ্টা মামুলি। আরো বেশি হলেও আশ্চর্যের নয়।
যমুনা সেতু হবার পরও টাঙ্গাইল রুটে যানজটের “উন্নয়ন” উত্তরাঞ্চলের জনগণ ভালোভাবেই টের পান। এবার ঈদেও পেয়েছেন।
তো, এই যদি হয় পরিবহণে এ জাতীয় উন্নয়নের ফল, তাহলে এ নিয়ে যে আহ্লাদের কিছু নেই সেটা বলেই দেয়া যায়।
আসলে বিষয়টা হলো, এসব উন্নয়ন হয় ভিন্ন কারণে, অন্য কারও স্বার্থে, জনগণের নয়। যেমনটা হয়েছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ক্ষেত্রে। তাতে কলকাতা থেকে দার্জিলিং যাওয়া জমিদারদের জন্য নিশ্চয়ই সহজ হয়েছিল। আর ব্রিটিশদের বাণিজ্য-স্বার্থ তো সবার উপরে।
তারপরও প্রশ্ন থাকে এক ধরনের উন্নয়ন-তো হচ্ছে বটে। তাই না? উন্নয়নটা হয়ে গেলে কম সময় লাগবে। ঝামেলা ছাড়া চলাচল করা যাবে। গ্রামের সবজি/কৃষি উৎপাদন দ্রুত ঢাকায় আসবে, ফলে কৃষকরা পয়সা পাবে। ওদিকে শিল্প-কারখানা হবে, জনগণের ভাগ্য খুলবে। ভালো তো।
কিন্তু কিছুটা গভীরে চিন্তা করা যাক।
নদী পথে অনুন্নয়নের এতো অবহেলা সত্তে¡ও এখনো স্টিমারে বরিশাল যেতে ৫/৬ ঘণ্টা লাগে। তাহলে মাত্র ২/৩ ঘণ্টা কমানোর জন্য এতো বিপুল অর্থ কেন ব্যয় করবে বাংলাদেশ? একটা গবেষণা বলছে, সড়কপথে শুধু যানজটের কারণেই বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো জ্বালানি খরচ বেশি হয় দেশের। তাহলে কেন জ্বালানি-খরচের আরো বর্ধিত-ব্যবস্থা করা হবে এ ধরনের পরিবহণ ব্যবস্থাকে বাড়িয়ে তুলে? গবেষণা আরো বলছে, সড়ক-দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ৭/৮ হাজার লোক মারা যাচ্ছেন, প্রায় ৫০ হাজার হচ্ছেন আহত, যাদের বড় একটি অংশ সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। এই পরিবহণ ব্যবস্থা বায়ুদূষণের একটা বড় কারণ। বিদেশের উপর জ্বালানি তেল ও গ্যাস নির্ভরতার এক বড় কারণ।
এরকম বৃহৎ সেতুর কারণে গ্রাম থেকে দলে দলে শ্রমজীবী মানুষ ঢাকায় এসে ভীড় করছেন। ঢাকা হয়ে পড়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুষিত বাতাসের শহর, সবচেয়ে খারাপ বসবাসযোগ্য একটি শহর। পদ্মাসেতুতে যারা আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সেই মধ্যবিত্তরা কয়েক বছরের মধ্যে টের পাবেন তাদের প্রিয় ঢাকায় তারা আর চলাচল করতে পারছেন না। যেখানে মফস্বলকে বা গ্রামকে ভিত্তি করে উন্নয়ন হতে হবে সেখানে সব কিছু রাজধানীকে কেন্দ্র করে চলার এক ভয়াবহ উন্নয়ন ধারায় দেশকে নিয়ে চলেছে সাম্রাজ্যবাদ। আর তাতে সানন্দে সায় দিচ্ছে তাদের দালাল বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি ও তাদের রাষ্ট্র, বিশেষত আওয়ামী সরকার।
পদ্মা সেতুর যে প্রকৃত গণবিরোধী, দেশবিরোধী ও বুর্জোয়া স্বার্থানুসারী অবদান তাহলো নৌ-পরিবহণকে হত্যা করা। নদী-খাল-বিল ধ্বংস করে ইতিমধ্যেই তাকে মুমূর্ষু করে ফেলা হয়েছে। পদ্মাসেতু সেই কফিনে এক বড় পেরেক মাত্র।
দক্ষিণাঞ্চলে যে ঐতিহ্যবাহী নৌ-পরিবহণ ব্যবস্থা এখনো টিম টিম করে জ্বলছিল তাকে ধ্বংসের পথে আরো এগিয়ে নিলো পদ্মাসেতু।
পরিবহণে উন্নয়ন যে দরকার নেই তা নয়। বরিশালে যদি ৩ ঘণ্টায় যাওয়া যায় তাহলে সেটা ভালো বটে। কিন্তু সেটা সবার সর্বদা দরকার নেই। আর নৌ-পরিবহণে কি সেটা অনেকটাই সম্ভব ছিল না? তার উন্নয়নের জন্য কী করা হয়েছে? তাকে উন্নত করলে এবং জনবান্ধব ব্যবস্থা থাকলে শুধু ৩ ঘণ্টায় বরিশাল যাওয়াই যে সম্ভব তা নয়, সেটা হতো অনেক বেশি নিরাপদ, অনেক বেশি পরিবেশ-বান্ধব, অনেক বেশি আরামদায়ক, অনেক বেশি অর্থ-সাশ্রয়ী।
সর্বোপরি, সড়ক পরিবহণের যে ধারাটিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে সেটি তার সকল ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভরতাকে বাড়িয়ে তুলছে। পদ্মা-সেতু যে তার ব্যতিক্রম নয় সেটা উপরেই দেখানো হয়েছে। এতে সাম্রাজ্যবাদের সাথে লাভবান হচ্ছে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি- প্রথমত, শাসকশ্রেণি রাষ্ট্র ও সরকারের কমিশন ভোগীরা, দ্বিতীয়ত পরিবহণ মালিকরা। ইতিমধ্যেই ১ হাজারের মতো বাস নতুন করে রাস্তায় নেমেছে। বাইককে আপাতত নিষিদ্ধ করা হলেও তাকেও ছাড়তে হবে। সাম্রাজ্যবাদীরা ও আমদানিকারকরা আরো লক্ষ লক্ষ বাইক-কার-বাস-ট্রাক-কার্গো এনে দেশের সড়কগুলো ভরে ফেলবে, ভরে ফেলবে ঢাকার রাস্তাগুলো। ফলে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের উপর পড়বে এক বড় ধরনের চাপ। ইতিমধ্যেই লোডশেডিং-এর জ্বালায় মধ্যবিত্তরা, এমনকি শিল্প-মালিকরাও কিছুটা মাত্র টের পাওয়া শুরু করেছেন।
বাংলাদেশ-পরিবহণে সাম্রাজ্যবাদী উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো, ঐতিহ্যবাহী নৌ-পরিবহণকে ধ্বংস করে দেয়া, এমনকি প্রয়োজনে রেলকেও নস্ট করা, এবং জায়গায় বেজায়গায় সড়ক নির্মাণ করা, বড় বড় সেতু তৈরি করা এবং সড়ক-যান নির্ভর করে গড়ে তোলা। এর পরিণতি হলো ছোটো এই দেশের বিপুল পরিমাণ কৃষি-জমি সড়ক নির্মাণে খেয়ে ফেলা, অর্থ ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর হয়ে পড়া, সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর ও সাম্রাজ্যবাদ-পরিকল্পিত শিল্প গড়ে তোলা, তার স্বার্থে দেশের গ্যাস পানি ভূমি বাতাস সম্পদ খেয়ে ফেলা, বিদেশ থেকে গাড়ী ও বাইক আমদানি এবং প্রচুর সড়ক দুর্ঘটনার কারণ তৈরি করা। পদ্মা সেতু সেটাই আরো বাড়াবে।
বড় বড় সেতু, দ্রুত যাতায়াত যে প্রয়োজন নয় তা নয়। কিন্তু প্রথমত, পরিবহণের দেশ-জনগণ-পরিবেশ বান্ধব ধারাকে ভিত্তি করে সেটা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের অর্থনীতি ও সমাজ-উন্নয়নে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। আমাদের দেশে এখন ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে (সড়ক ও রেলসহ) পদ্মা সেতু অপরিহার্য নয়। অপরিহার্য হলো, প্রতিটি মহাসড়কে এবং নগরগুলোর প্রতিটি বড়ো সড়কে অযান্ত্রিক বা ছোটো যানবাহন চলাচলের জন্য পৃথক লেন নির্মাণ করা। রাস্তাগুলোকে সাইকেল জাতীয় অযান্ত্রিক বাহনের উপযোগী করে বিপুল সাইকেল-শিল্প গড়ে তোলা। নৌ-পথকে উন্নত করার জন্য খাল-বিল-নদী ধ্বংসকে রুখে দিয়ে নাব্যতা বৃদ্ধি করা। নৌ-পরিবহণকে আধুনিকীকরণ করা, দেশজ প্রযুক্তি-নির্ভর করা ও তার উন্নয়ন সাধন করা।
এছাড়া এখনই দরকার ৫ হাজার ইউনিয়নে উন্নত হাসপাতাল তৈরি করা। প্রতি বিভাগে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। প্রতিটি জেলায় বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা। সৌর-বিদ্যুৎ, জৈব বিদ্যুৎ ইত্যাদির বিপুল ব্যবস্থা করা, যাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভর করতে না হয়। দরকার হলো রাজধানীতে ও নগরগুলোতে মানুষের ঢল বন্ধ করে গ্রামাঞ্চল ও মফস্বলকে উন্নয়নের ভিত্তি করা। সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর শিল্প-উন্নয়ন থেকে বেরিয়ে আসা। এবং আরো বহু কিছু।
বিদেশ-নির্ভর, পরিবেশ ধ্বংসকারী ও জমি-পানি-গ্যাসসহ দেশজ সম্পদ শুষে নেয়া উন্নয়নকে বাতিল করে কৃষিকে ভিত্তি করে ও কৃষি-নির্ভর শিল্প গড়ে তোলায় মনোযোগী হওয়া।
এই রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণি সেপথে যাবে না এবং যেতে পারেও না। তাদের অগ্রাধিকার হলো বিদেশিদের পরিকল্পনায় তাদেরই স্বার্থের বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়া, যাতে তারা নিজেরা তার থেকে কমিশন খেয়ে, দুর্নীতি করে, নিজেরাও বড় অর্থের মালিক বনতে পারে, এবং সেই অর্থ তারা কানাডাসহ বিদেশে পাচার করতে পারে। এই দেশ তাদের নয়। এখানে তারা লুটপাট করে এবং টাকা কামাই-এর উর্বর-অঞ্চল হিসেবে ব্যবহার করে মাত্র।
এদের কবল থেকে না বেরুলে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন কখনই হবে না।
আরও খবর
- শনি
- রোব
- সোম
- মঙ্গল
- বুধ
- বৃহ
- শুক্র