ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকসহ গণ-নির্যাতন চলছেই

আন্দোলন প্রতিবেদন
শুক্রবার, ১২ মে ২০২৩ | অনলাইন সংস্করণ
২৬ মার্চে প্রথম আলোর একটি অনলাইন প্রতিবেদনে একজন দিনমজুরের বক্তব্য উদ্ধৃত করে লেখা হয়, “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব”। এই উদ্ধৃতির সঙ্গে একটি শিশু ফুল হাতে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এমন একটি ফেসবুক ফটোকার্ড ও খবরের স্ক্রিনশট বেশ ভাইরাল হয়।
এরই প্রতিক্রিয়ায় গত ২৯ মার্চ ভোরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একদল সদস্য সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই। তুলে নেয়ার পর প্রায় দশ ঘন্টা তার খোঁজ ছিল না। শামসুজ্জামানকে নিয়ে যাওয়ার পৌনে দুই ঘন্টা আগে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম কিবরিয়া। তবে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা অপর একটি মামলায়। ওই মামলা হয় তাকে তুলে নেয়ার ১৯ ঘন্টা পর। ঐ মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং একজন আলোকচিত্রীসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। এ ঘটনায় দেশে বিদেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলেরও দাবি ওঠে আরো জেরালোভাবে।
প্রতিবেদনের উদ্ধৃতিকে বানোয়াট মন্তব্য করে তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ এবং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন– একটা বাচ্চা ছেলেকে ১০ টাকা দিয়ে ফুসলিয়ে এ কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে শিশু নির্যাতনের জন্য শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংবাদপত্র এবং বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা বলছেন বক্তব্যের সাথে ছবির অসঙ্গতি দেখে প্রথম আলো কার্ডটি দ্রুতই প্রত্যাহার করে এবং প্রতিবেদনে সংশোধনী প্রকাশ করে। এছাড়াও আওয়ামী লীগের পদলেহনকারী সেলিব্রেটিদের মতে দিনমজুরের মন্তব্য তার ভাষাজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উল্লেখ্য উদ্ধৃতিটির নিচে লেখা ছিল দিনমজুর জাকির হোসেন– অর্থাৎ এটি জাকির হোসেনের বক্তব্য। তবে এটি অবাক করার মত যে এই প্রশ্নে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি! ঐ ছবি দিয়ে তিনি কি বুঝিয়েছিলেন? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য– আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশের জরিপে দেখা যায় ৮২.২ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারছে না। আর বাংলাদেশের দরিদ্র বাচ্চারা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করে তা অতি সাধারণ ঘটনা।
মানবাধিকার ও সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর মানবাধিকার প্রতিবেদন বলেছে, মার্চ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১০টি মামলায় ৭ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে মামলার সংখ্যা ছিল ৫। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসের মধ্যে দেশে ৫৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আলী রিয়াজের সংগৃহিত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে এই আইন কার্যকর হওয়ার পর অর্থাৎ ’১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ১০৯টি মামলায় ২ হাজার ৮৮৯ জন অভিযুক্ত হয়েছেন এবং আটক হয়েছেন ১,১১৯ জন। এই মামলায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অভিযুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদদের হার বেশি।
এই আইন দেশের নাগরিকদের সুরক্ষার বদলে আওয়ামী নেতা ও মন্ত্রীদের সুরক্ষা দিচ্ছে। ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমপিদের মান-ইজ্জত রক্ষা করবে। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে সরকার, নেতা, মন্ত্রী, এমপিদের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যম বা গণমাধ্যমে যেকোনো ধরনের সমালোচনা হলেই মামলা এবং গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো ‘কটূক্তি’ এবং সরকারি রাজনীতিবিদদের মানহানির অভিযোগে শত শত মামলা এবং আটক হচ্ছেন। এমনকি কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক করা হচ্ছে এবং নির্যাতন করা হচ্ছে। তার বড় উদাহরণ হলো লেখক মুশতাক আহমেদ ও সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু। কাটুর্নিষ্ট কিশোরও এমন অভিযোগ করেছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সরকার একটি ফ্যাসিবাদী রাজত্ব কায়েম করেছে। এই আইন বাতিলসহ ফ্যাসিবাদী সরকারের অবসানে গড়ে উঠা আন্দোলন বেগবান করা অতীব জরুরি।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকসহ গণ-নির্যাতন চলছেই
২৬ মার্চে প্রথম আলোর একটি অনলাইন প্রতিবেদনে একজন দিনমজুরের বক্তব্য উদ্ধৃত করে লেখা হয়, “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব”। এই উদ্ধৃতির সঙ্গে একটি শিশু ফুল হাতে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এমন একটি ফেসবুক ফটোকার্ড ও খবরের স্ক্রিনশট বেশ ভাইরাল হয়।
এরই প্রতিক্রিয়ায় গত ২৯ মার্চ ভোরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একদল সদস্য সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই। তুলে নেয়ার পর প্রায় দশ ঘন্টা তার খোঁজ ছিল না। শামসুজ্জামানকে নিয়ে যাওয়ার পৌনে দুই ঘন্টা আগে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম কিবরিয়া। তবে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা অপর একটি মামলায়। ওই মামলা হয় তাকে তুলে নেয়ার ১৯ ঘন্টা পর। ঐ মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং একজন আলোকচিত্রীসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। এ ঘটনায় দেশে বিদেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলেরও দাবি ওঠে আরো জেরালোভাবে।
প্রতিবেদনের উদ্ধৃতিকে বানোয়াট মন্তব্য করে তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ এবং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন– একটা বাচ্চা ছেলেকে ১০ টাকা দিয়ে ফুসলিয়ে এ কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে শিশু নির্যাতনের জন্য শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংবাদপত্র এবং বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা বলছেন বক্তব্যের সাথে ছবির অসঙ্গতি দেখে প্রথম আলো কার্ডটি দ্রুতই প্রত্যাহার করে এবং প্রতিবেদনে সংশোধনী প্রকাশ করে। এছাড়াও আওয়ামী লীগের পদলেহনকারী সেলিব্রেটিদের মতে দিনমজুরের মন্তব্য তার ভাষাজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উল্লেখ্য উদ্ধৃতিটির নিচে লেখা ছিল দিনমজুর জাকির হোসেন– অর্থাৎ এটি জাকির হোসেনের বক্তব্য। তবে এটি অবাক করার মত যে এই প্রশ্নে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি! ঐ ছবি দিয়ে তিনি কি বুঝিয়েছিলেন? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য– আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশের জরিপে দেখা যায় ৮২.২ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারছে না। আর বাংলাদেশের দরিদ্র বাচ্চারা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করে তা অতি সাধারণ ঘটনা।
মানবাধিকার ও সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর মানবাধিকার প্রতিবেদন বলেছে, মার্চ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১০টি মামলায় ৭ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে মামলার সংখ্যা ছিল ৫। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসের মধ্যে দেশে ৫৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আলী রিয়াজের সংগৃহিত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে এই আইন কার্যকর হওয়ার পর অর্থাৎ ’১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ১০৯টি মামলায় ২ হাজার ৮৮৯ জন অভিযুক্ত হয়েছেন এবং আটক হয়েছেন ১,১১৯ জন। এই মামলায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অভিযুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদদের হার বেশি।
এই আইন দেশের নাগরিকদের সুরক্ষার বদলে আওয়ামী নেতা ও মন্ত্রীদের সুরক্ষা দিচ্ছে। ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমপিদের মান-ইজ্জত রক্ষা করবে। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে সরকার, নেতা, মন্ত্রী, এমপিদের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যম বা গণমাধ্যমে যেকোনো ধরনের সমালোচনা হলেই মামলা এবং গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো ‘কটূক্তি’ এবং সরকারি রাজনীতিবিদদের মানহানির অভিযোগে শত শত মামলা এবং আটক হচ্ছেন। এমনকি কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক করা হচ্ছে এবং নির্যাতন করা হচ্ছে। তার বড় উদাহরণ হলো লেখক মুশতাক আহমেদ ও সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু। কাটুর্নিষ্ট কিশোরও এমন অভিযোগ করেছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সরকার একটি ফ্যাসিবাদী রাজত্ব কায়েম করেছে। এই আইন বাতিলসহ ফ্যাসিবাদী সরকারের অবসানে গড়ে উঠা আন্দোলন বেগবান করা অতীব জরুরি।
আরও খবর
- শনি
- রোব
- সোম
- মঙ্গল
- বুধ
- বৃহ
- শুক্র