• বৃহঃস্পতিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
  • ঢাকা, বাংলাদেশ
“জয় বাংলা” স্লোগান
“জয় বাংলা” স্লোগান

  আন্দোলন প্রতিবেদন  

শনিবার, ২ এপ্রিল ২০২২  |  অনলাইন সংস্করণ

গত ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার এক সভায় “জয় বাংলা”-কে জাতীয় স্লোগান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রয়োগগত দিকটাও তারা পরিষ্কার করেছে - সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সকল অনুষ্ঠানের শেষে এ স্লোগান দিতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাদের ভাষণের শেষে সেটা করবেন। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলো সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিনকার ‘এ্যাসেম্বলি’-তে এই স্লোগানটি দিতে হবে। এর আগে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিন “শপথ” নেয়ার বক্তব্য একইভাবে ঠিক করে দিয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ ৫০-বছর পর এসে এমন একটি “জাতীয় স্লোগানে”র সিদ্ধান্ত গ্রহণ কেন সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সিদ্ধান্তটি নিয়েছে আওয়ামী সরকার, কোনো জাতীয় সরকার নয়, কোনো বিপ্লবী সরকার নয়, বা বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য সংগ্রামকারী সকল শক্তির মতৈক্যের সরকার নয়। যে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে কি না সকল বিরোধী পক্ষের অভিযোগ রয়েছে বিনা ভোটে বা ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এবং স্বৈরাচারি কায়দায় দেশ শাসনের। অর্থাৎ, বুর্জোয়া অর্থেও যারা জনগণকে ও আজকের অবস্থায় জাতীয় চেতনাকে প্রতিনিধিত্ব করে না।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৫০ বছর ধরে, এমনকি তার আগেও, “জয় বাংলা” স্লোগানটি সকল মহলেই পরিচিত ছিল একটি আওয়ামী স্লোগান হিসেবে। ’৭১-এর আগে এ স্লোগান আওয়ামী লীগই এনেছিল। সে সময়ও এটি তৎকালীন পূর্ব বাংলার উপর পাকিস্তান রাষ্ট্রের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সকল পক্ষের স্লোগান ছিল না। এর নিশ্চয়ই কারণ ছিল। প্রথমত, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে ভূখণ্ড তার নাম কখনই “বাংলা” ছিল না। বাংলা ছিল এখন যা পশ্চিম বাংলা সেটি সহ সমগ্র বাংলা অঞ্চলের নাম। কিন্তু ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, বা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে এই বাংলাকে বিভক্ত করা হয়। এবং তার পূর্ব অংশ অর্থাৎ পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে সময়, এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও বেশ কিছু বছর এর প্রাতিষ্ঠানিক নাম ছিল “পূর্ব বাংলা” বা “পূর্ববঙ্গ”। জনগণসহ আওয়ামী লীগও সেটাই বলতো। বাংলার পশ্চিম অংশটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব বাংলার এই স্বকীয় পরিচয়কে মুছে ফেলার জন্য একে “পূর্ব পাকিস্তান” নামকরণ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় “পূর্ব বাংলা/পূর্ব বঙ্গ” নামটিই ভেসে উঠতে থাকে। আওয়ামী লীগ ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের নেতৃত্বে চলে যাবার পর কয়েক বছর ধরে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচিকে বিরোধিতা করে। ১৯৬৬ সালে বহুবিধ দেশীয়-আন্তর্জাতিক কারণে ৬-দফা পেশের মাধ্যমে পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এবং তারা এক পর্যায়ে তাদের রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে “জয় বাংলা”-কে ব্যাপকভাবে মাঠে নিয়ে আসে। বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আওতাধীন ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক নামের সাথে এর সাংঘর্ষিক অবস্থান ছাড়াও এ স্লোগানে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং গণশত্রু আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের বিরোধী রাজনীতির কোনো প্রকাশ ছিল না। শুধু পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়নের বিরোধী অবস্থানকে সেটা প্রকাশ করেছিল। তথাপি সে সময়কালে এটুকু ইতিবাচকতা তার ছিল। কিন্তু এর বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী অবস্থান ও ঐতিহাসিক বিভ্রান্তিকে ভুলে গেলে চলবে না - যা কি না জাতি ও জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা ও মু্িক্তর কর্মসূচিকে প্রতিফলিত করতো না। ’৭১-সালের যুদ্ধকালেও আওয়ামী নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধকে দল-মত নির্বিশেষে দেশের সকল জনগণের সংগ্রাম হিসেবে সংগঠিত না করে আওয়ামী দলীয়করণের অংশ হিসেবে এ স্লোগানকেই চালু রাখে। সে সময়ে পাকিস্তানি গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূলিকরণের যুদ্ধকালে এ স্লোগানের যা কিছু ইতিবাচক দিক ছিল সেটাও বিলুপ্ত হয়ে যায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর। কারণ, সে সময় থেকে আওয়ামী নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের দালাল বাঙালি আমলা-মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির স্লোগানে এটি পরিণত হয়। এটা পরিণত হয় জনগণের শত্রু পক্ষের স্লোগানে। স্বভাবতই জনগণ নিজেদেরকে এর থেকে পৃথক রাখেন। এমনকি শাসক শ্রেণির নিজেদের মধ্যে যখন ভাঙন ধরে, তখন আওয়ামী বিরোধী অংশটিও (যেমন, বিএনপি) এ স্লোগানটিকে বর্জন করে ও নতুন স্লোগান চালু করে। তাই, এটা স্পষ্ট যে “জয় বাংলা” বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনগণ তো দূরের কথা, শাসক বুর্জোয়া শ্রেণিরও সকলের স্লোগান নয়। ফলে এটা “জাতীয় স্লোগান” হবে কীভাবে?

* “জয় বাংলা” স্লোগানের উপরোক্ত রাজনৈতিক সমস্যাগুলো বাদেও ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট তার ত্রুটি থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলো গুরুত্ব সহকারেই দেখা উচিত। যা আবার তার রাজনৈতিক সমস্যার উৎস ও তার সাথে যুক্ত। প্রথমত, আগেই যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে এই ভূখণ্ড “বাংলা” নয়, “পূর্ব বাংলা”। বাংলা বললে “বৃহত্তর বাংলা”-কেই বোঝানো হয়, যার অর্থ হলো ভারতের পশ্চিম বাংলা/পশ্চিম বঙ্গ প্রদেশের সাথে যুক্ত ভাবে একটি যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে বুঝে বা না বুঝে অনুমোদন দেয়া। এ প্রশ্ন সর্বদাই উঠেছে এবং উঠতে বাধ্য। এমনকি পাকিস্তান আমলেও উঠেছিল। যে কারণে এই স্লোগানটি আওয়ামী স্লোগান হিসেবেই রয়ে গিয়েছিল। যুক্ত বাংলা দু’ভাবে হতে পারে। এক, পশ্চিম বাংলা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের সাথে একত্রে প্রকৃত “বাংলা” নামে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দুই, বর্তমান বাংলাদেশকে পশ্চিমবাংলার সাথে যুক্ত করে যুক্ত বাংলা প্রদেশ হিসেবে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা।  এ দুয়ের কোনোটাই বর্তমানের প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত নয়। তবুও কেউ সেরকম বিশ্বাস পোষণ করলে সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে বৃহৎ ভারত রাষ্ট্রের সম্প্রসারণবাদের ষড়যান্ত্রিক খপ্পরে পড়তে বাধ্য। তাহলে কেন সেরকম বিভ্রান্তিকর ও বিপজ্জনক শব্দ ও স্লোগান এদেশের জনগণ ব্যবহার করবেন? দ্বিতীয়ত, ভারতের পশ্চিম বাংলাকে কিছুদিন আগে “বাংলা” নামকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানকার প্রধান বুর্জোয়া পার্টি ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের দিক থেকে সে প্রস্তাবটি এসেছে। তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজে “জয় বাংলা” স্লোগান দিচ্ছেন। এসবকে মোটেই গুরুত্বহীন করা যাবে না। তাই, আজকে “বাংলা” নামে স্লোগানটি যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর হতে বাধ্য। সেটা পশ্চিম বাংলাকে বোঝাবে না তারই বা গ্যারান্টি কী? তৃতীয়ত, ’৭১-সালে সৃষ্ট এই রাষ্ট্রটির নাম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে “বাংলাদেশ”, “বাংলা” নয়। তাই, সাংবিধানিক ভাবেও “বাংলা” স্লোগানটি বৈধ নয়। কৌতুকের বিষয় হলো এই যে, খোদ হাইকোর্টই এই স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান করার নির্দেশ দিয়েছিল। এটা কি আইনের বিষয়, বিচারের বিষয়? নাকি রাজনৈতিক বিষয়?

* পরিশেষে আবার শুরুর কথায় ফেরা যায়। কেন আওয়ামী সরকার সুদীর্ঘ ৫০ বছর পর এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, সবকিছুকে আওয়ামীকরণ করা মাত্র। বর্তমান সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। ’৭১-এর গণ-আবেগকে বর্তমানে তাদের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির স্বার্থে কাজে লাগানো ছাড়া আর কোনো রাজনীতি তাদের নেই।

জনগণকে এথেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বুঝতে হবে যে, শাসকদের স্লোগান তাদের নয়, এ রাষ্ট্র তাদের নয়। ফলে দেশটিও তাদের দখলে নেই। সেজন্যই সংগ্রাম করতে হবে। দেশকে দখলে নিন। গণবিরোধী বুর্জোয়া শক্তিকে উচ্ছেদ করুন।

“জয় বাংলা” স্লোগান

 আন্দোলন প্রতিবেদন 
শনিবার, ২ এপ্রিল ২০২২  |  অনলাইন সংস্করণ

গত ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার এক সভায় “জয় বাংলা”-কে জাতীয় স্লোগান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রয়োগগত দিকটাও তারা পরিষ্কার করেছে - সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সকল অনুষ্ঠানের শেষে এ স্লোগান দিতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাদের ভাষণের শেষে সেটা করবেন। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলো সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিনকার ‘এ্যাসেম্বলি’-তে এই স্লোগানটি দিতে হবে। এর আগে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিন “শপথ” নেয়ার বক্তব্য একইভাবে ঠিক করে দিয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ ৫০-বছর পর এসে এমন একটি “জাতীয় স্লোগানে”র সিদ্ধান্ত গ্রহণ কেন সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সিদ্ধান্তটি নিয়েছে আওয়ামী সরকার, কোনো জাতীয় সরকার নয়, কোনো বিপ্লবী সরকার নয়, বা বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য সংগ্রামকারী সকল শক্তির মতৈক্যের সরকার নয়। যে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে কি না সকল বিরোধী পক্ষের অভিযোগ রয়েছে বিনা ভোটে বা ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এবং স্বৈরাচারি কায়দায় দেশ শাসনের। অর্থাৎ, বুর্জোয়া অর্থেও যারা জনগণকে ও আজকের অবস্থায় জাতীয় চেতনাকে প্রতিনিধিত্ব করে না।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৫০ বছর ধরে, এমনকি তার আগেও, “জয় বাংলা” স্লোগানটি সকল মহলেই পরিচিত ছিল একটি আওয়ামী স্লোগান হিসেবে। ’৭১-এর আগে এ স্লোগান আওয়ামী লীগই এনেছিল। সে সময়ও এটি তৎকালীন পূর্ব বাংলার উপর পাকিস্তান রাষ্ট্রের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সকল পক্ষের স্লোগান ছিল না। এর নিশ্চয়ই কারণ ছিল। প্রথমত, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে ভূখণ্ড তার নাম কখনই “বাংলা” ছিল না। বাংলা ছিল এখন যা পশ্চিম বাংলা সেটি সহ সমগ্র বাংলা অঞ্চলের নাম। কিন্তু ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, বা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে এই বাংলাকে বিভক্ত করা হয়। এবং তার পূর্ব অংশ অর্থাৎ পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে সময়, এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও বেশ কিছু বছর এর প্রাতিষ্ঠানিক নাম ছিল “পূর্ব বাংলা” বা “পূর্ববঙ্গ”। জনগণসহ আওয়ামী লীগও সেটাই বলতো। বাংলার পশ্চিম অংশটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব বাংলার এই স্বকীয় পরিচয়কে মুছে ফেলার জন্য একে “পূর্ব পাকিস্তান” নামকরণ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় “পূর্ব বাংলা/পূর্ব বঙ্গ” নামটিই ভেসে উঠতে থাকে। আওয়ামী লীগ ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের নেতৃত্বে চলে যাবার পর কয়েক বছর ধরে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচিকে বিরোধিতা করে। ১৯৬৬ সালে বহুবিধ দেশীয়-আন্তর্জাতিক কারণে ৬-দফা পেশের মাধ্যমে পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এবং তারা এক পর্যায়ে তাদের রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে “জয় বাংলা”-কে ব্যাপকভাবে মাঠে নিয়ে আসে। বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আওতাধীন ভূখণ্ডের ঐতিহাসিক নামের সাথে এর সাংঘর্ষিক অবস্থান ছাড়াও এ স্লোগানে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং গণশত্রু আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের বিরোধী রাজনীতির কোনো প্রকাশ ছিল না। শুধু পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়নের বিরোধী অবস্থানকে সেটা প্রকাশ করেছিল। তথাপি সে সময়কালে এটুকু ইতিবাচকতা তার ছিল। কিন্তু এর বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী অবস্থান ও ঐতিহাসিক বিভ্রান্তিকে ভুলে গেলে চলবে না - যা কি না জাতি ও জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা ও মু্িক্তর কর্মসূচিকে প্রতিফলিত করতো না। ’৭১-সালের যুদ্ধকালেও আওয়ামী নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধকে দল-মত নির্বিশেষে দেশের সকল জনগণের সংগ্রাম হিসেবে সংগঠিত না করে আওয়ামী দলীয়করণের অংশ হিসেবে এ স্লোগানকেই চালু রাখে। সে সময়ে পাকিস্তানি গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূলিকরণের যুদ্ধকালে এ স্লোগানের যা কিছু ইতিবাচক দিক ছিল সেটাও বিলুপ্ত হয়ে যায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর। কারণ, সে সময় থেকে আওয়ামী নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের দালাল বাঙালি আমলা-মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির স্লোগানে এটি পরিণত হয়। এটা পরিণত হয় জনগণের শত্রু পক্ষের স্লোগানে। স্বভাবতই জনগণ নিজেদেরকে এর থেকে পৃথক রাখেন। এমনকি শাসক শ্রেণির নিজেদের মধ্যে যখন ভাঙন ধরে, তখন আওয়ামী বিরোধী অংশটিও (যেমন, বিএনপি) এ স্লোগানটিকে বর্জন করে ও নতুন স্লোগান চালু করে। তাই, এটা স্পষ্ট যে “জয় বাংলা” বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনগণ তো দূরের কথা, শাসক বুর্জোয়া শ্রেণিরও সকলের স্লোগান নয়। ফলে এটা “জাতীয় স্লোগান” হবে কীভাবে?

* “জয় বাংলা” স্লোগানের উপরোক্ত রাজনৈতিক সমস্যাগুলো বাদেও ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট তার ত্রুটি থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলো গুরুত্ব সহকারেই দেখা উচিত। যা আবার তার রাজনৈতিক সমস্যার উৎস ও তার সাথে যুক্ত। প্রথমত, আগেই যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে এই ভূখণ্ড “বাংলা” নয়, “পূর্ব বাংলা”। বাংলা বললে “বৃহত্তর বাংলা”-কেই বোঝানো হয়, যার অর্থ হলো ভারতের পশ্চিম বাংলা/পশ্চিম বঙ্গ প্রদেশের সাথে যুক্ত ভাবে একটি যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে বুঝে বা না বুঝে অনুমোদন দেয়া। এ প্রশ্ন সর্বদাই উঠেছে এবং উঠতে বাধ্য। এমনকি পাকিস্তান আমলেও উঠেছিল। যে কারণে এই স্লোগানটি আওয়ামী স্লোগান হিসেবেই রয়ে গিয়েছিল। যুক্ত বাংলা দু’ভাবে হতে পারে। এক, পশ্চিম বাংলা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের সাথে একত্রে প্রকৃত “বাংলা” নামে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দুই, বর্তমান বাংলাদেশকে পশ্চিমবাংলার সাথে যুক্ত করে যুক্ত বাংলা প্রদেশ হিসেবে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা।  এ দুয়ের কোনোটাই বর্তমানের প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত নয়। তবুও কেউ সেরকম বিশ্বাস পোষণ করলে সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে বৃহৎ ভারত রাষ্ট্রের সম্প্রসারণবাদের ষড়যান্ত্রিক খপ্পরে পড়তে বাধ্য। তাহলে কেন সেরকম বিভ্রান্তিকর ও বিপজ্জনক শব্দ ও স্লোগান এদেশের জনগণ ব্যবহার করবেন? দ্বিতীয়ত, ভারতের পশ্চিম বাংলাকে কিছুদিন আগে “বাংলা” নামকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানকার প্রধান বুর্জোয়া পার্টি ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের দিক থেকে সে প্রস্তাবটি এসেছে। তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজে “জয় বাংলা” স্লোগান দিচ্ছেন। এসবকে মোটেই গুরুত্বহীন করা যাবে না। তাই, আজকে “বাংলা” নামে স্লোগানটি যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর হতে বাধ্য। সেটা পশ্চিম বাংলাকে বোঝাবে না তারই বা গ্যারান্টি কী? তৃতীয়ত, ’৭১-সালে সৃষ্ট এই রাষ্ট্রটির নাম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে “বাংলাদেশ”, “বাংলা” নয়। তাই, সাংবিধানিক ভাবেও “বাংলা” স্লোগানটি বৈধ নয়। কৌতুকের বিষয় হলো এই যে, খোদ হাইকোর্টই এই স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান করার নির্দেশ দিয়েছিল। এটা কি আইনের বিষয়, বিচারের বিষয়? নাকি রাজনৈতিক বিষয়?

* পরিশেষে আবার শুরুর কথায় ফেরা যায়। কেন আওয়ামী সরকার সুদীর্ঘ ৫০ বছর পর এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, সবকিছুকে আওয়ামীকরণ করা মাত্র। বর্তমান সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। ’৭১-এর গণ-আবেগকে বর্তমানে তাদের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির স্বার্থে কাজে লাগানো ছাড়া আর কোনো রাজনীতি তাদের নেই।

জনগণকে এথেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বুঝতে হবে যে, শাসকদের স্লোগান তাদের নয়, এ রাষ্ট্র তাদের নয়। ফলে দেশটিও তাদের দখলে নেই। সেজন্যই সংগ্রাম করতে হবে। দেশকে দখলে নিন। গণবিরোধী বুর্জোয়া শক্তিকে উচ্ছেদ করুন।

আরও খবর
 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র