ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যের সমস্যা

আন্দোলন প্রতিবেদন
বৃহঃস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২২ | অনলাইন সংস্করণ
দেশে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে কি না, বা আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী শক্তি কি না তা নিয়ে সাম্রাজ্যাবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে সন্দেহ নেই। কোনো কোনো বামপন্থি একে “ফ্যাসিবাদ” না বলে “স্বৈরতন্ত্র” বলাকে তাত্ত্বিক ভাবে সঠিক মনে করেন। তবে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্র– যা-ই বলা হোক না কেন, গুটিকয় আওয়ামী-দালাল ব্যতীত সবাই মনে করেন যে, এই সরকার গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে বা তারা একটি গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি। সুতরাং গণতন্ত্রের জন্য ফ্যাসিবিরোধী/স্বৈরতন্ত্রবিরোধী সংগ্রাম প্রয়োজন এবং তাতে এ ধরনের শক্তিগুলোর মাঝে ঐক্যও প্রয়োজন।
কিন্তু গণতন্ত্র কাকে বলবো? অথবা শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মধ্যবিত্তের জন্য কী ধরনের গণতন্ত্র প্রয়োজন? এমনকি বিএনপি’র মতো শাসকশ্রেণির দলও গণতন্ত্র’র কথা বলে এবং একারণে তারা এখন সরকার/আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদীও বলে থাকে। আজকে বুর্জোয়া রাজনীতির বিরাট সার্কেলই আওয়ামী শাসনকে গণতন্ত্রবিরোধী শাসন বলছে এবং ’৯০-পরবর্তী ১৫ বছরের শাসনকে গণতন্ত্র বলে পেশ করছে, তার হাজারো ‘ত্রুটি’ ও ‘দুর্বলতা’ সত্ত্বেও। তাই, তাদের ‘গণতন্ত্র’টি অস্পষ্ট নয়। তাহলো, বিদ্যমান ব্যবস্থা/রাষ্ট্রকে অক্ষত রেখে তার অধীনে একটি নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। বিএনপি বা এ ধরনের বুর্জোয়া বিরোধীরা সেটাই চাইছে।
এদের কেউ কেউ অবশ্য ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ বা এ জাতীয় কথাও বলছে- যেমন ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। কিন্তু সে সংস্কারের বিষয়টি মূলত নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। বড়জোর দুর্নীতি-বিরোধী কিছু বিচার-আচার, বা সংবিধানের কিছু সংস্কারের কর্মসূচিকে তারা তুলে ধরে– যদিও তাদের এগুলো খুব একটা স্পষ্ট নয়, বা নির্দিষ্ট নয়। এবং এ প্রশ্নে তাদের মাঝে খুব একটা ঐক্যও নেই।
প্রশ্ন হলো, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিগুলো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে কী কর্মসূচি তুলে ধরবে? উপরোক্ত বুর্জোয়া কর্মসূচি ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তার পার্থক্য কোথায়? তারা কি চলমান ব্যবস্থাধীন একটি নিরপেক্ষ অবাধ ভোটের জন্য লড়াই করবে বা করছে?
এর স্পষ্ট উত্তর হলো, না। শ্রমিক কৃষক নিপীড়িত জনগণ ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই করবে তাদের নিজস্ব কর্মসূচিকে সামনে রেখে ও তার ভিত্তিতে; বুর্জোয়া কর্মসূচির জন্য নয়। বুর্জোয়া বিরোধীরা আজকের ফ্যাসিবাদী পরিস্থিতিতে নিপীড়নের চাপে কিছু কিছু গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি তুলে ধরছে বটে। কিন্তু তাদের কেন্দ্রীয় বিষয়টি হলো নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। তারা জনগণের জন্য কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে না এবং সেরকম কোনো কর্মসূচিও তাদের নেই।
এটা ঠিক যে, গোটা শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ধ্বংস করে জনগণের বিপ্লবী শাসন কায়েম করার রণনৈতিক কর্মসূচির সাথে ফ্যাসিবিরোধী কর্মসূচির পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু খোদ ফ্যাসিবিরোধী লড়াইকেও আমাদের পরিচালিত করতে হবে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার একটি ধাপ হিসেবে। এবং সেজন্য একটি বিপ্লবী কর্মসূচি থাকতে হবে। যদিও সেটা রণনৈতিক সমগ্র কর্মসূচি হবে না, কিন্তু তাকে সেটা সহায়তা করতে হবে, তার অংশ হতে হবে।
নতুবা ফ্যাসিবিরোধী লড়াই পর্যবসিত হবে শাসকশ্রেণির মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইয়ের অংশে। যেটা হয়েছিল ’৯০-সালের এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে। যেখানে হাসিনা-খালেদার আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া নেতৃত্ব আন্দোলনটিকে ব্যক্তি-এরশাদ সরানোর কর্মসূচিতে নামিয়ে দিয়েছিল; ব্যবস্থা, শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে রক্ষা করেছিল এবং সামরিক শাসনকে সরিয়ে ব্যবস্থার অধীনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কিছু সংস্কারকে মেনে নিয়েছিল। আর তাতে হাত মিলিয়েছিল বহু বামপন্থি নামের অধঃপতিত দালালরা। জনগণের মৌলিক কোনো অর্জনই হয় নি, একদিনের ভোটদানের অধিকার ছাড়া, তাও আবার গণশত্রু শাসকশ্রেণির মধ্য থেকেই কাউকে বাছাই করার জন্য। ১৫ বছরের ‘গণতান্ত্রিক’ শাসনে সবাই সেটা দেখেছেন। এমনকি বিদ্যমান ব্যবস্থা (তার বিচার-ব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র ও সংবিধান, এবং সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের সহায়তায়) সে রকম ‘ভোটের অধিকার’-কেও নির্বাসনে পাঠিয়েছে হাসিনা-আওয়ামী নেতৃত্বে, বিগত এক দশক ধরে।
তাই, বিপুল ত্যাগ, শ্রম, জীবন, সম্পদ ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জনগণ সে রকম একটি সমাধান কেন আবার টেনে আনবেন? পার্থক্যটা হলো ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংস্কার, নাকি বিপ্লবী উত্থান? বুর্জোয়াদের থেকে জনগণের বা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তির এটাই হলো পার্থক্য– ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে। এটা ভুলে গেলে বারবার একই বৃত্তে ঘুরতে হবে। তাই জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে ফ্যাসিবিরোধী সেরকম একটি কর্মসূচিকেই সামনে আনতে হবে। যাকে তাত্ত্বিক ভাষায় কৌশলগত কর্মসূচি বলা যেতে পারে।
* আজকের পরিস্থিতিতে সেরকম সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি দেশে খুব একটা শক্তিমান নয়। তারা বহু কেন্দ্রে বিভক্ত। কিন্তু তারাই ব্যাপক নিপীড়িত শোষিত জনগণের স্বার্থকে ধারণ করেন। এবং তারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া পতাকার বদলে একটি গণ-পতাকা তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। এটাই আবার তাদের মাঝে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং একটি জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তাকেও জোরালোভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়া সহজ বিষয় নয়। এমনকি তা যদি একটি যুক্তফ্রন্ট জাতীয় বা আরো ঢিলেঢালা ধরনেরও হয়। কারণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের মধ্যে বহু তাত্ত্বিক মত রয়েছে। রয়েছে আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য। রণনীতির ক্ষেত্রে বিপরীতধর্মী মত ও অবস্থান। ফ্যাসিবাদ ও কৌশলগত বিষয়ে বিবিধ ধরনের উপলব্ধি।
এসব কারণে এ শক্তিগুলোর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ ঐক্যের দিকগুলো সত্ত্বেও একটি কার্যকর জোট-গঠনের কাজ বিকশিত হতে পারছে না।
এ ধরনের সংগঠনগুলো শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রবিরোধী, ফ্যাসিবাদ/স্বৈরতন্ত্র বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সমাজতন্ত্রকামী, শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা কায়েমে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং ফ্যাসিবিরোধী একটি জোটবদ্ধ কার্যক্রমে আগ্রহী। এগুলো হলো ঐকমত্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক।
কিন্তু ফ্যাসিবিরোধী যুক্তকার্যক্রমকে উচ্চতর জায়গায় বিকশিত করার ক্ষেত্রে তাদের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ বহু পার্থক্যও রয়েছে। একটি ঐক্যবদ্ধ কৌশলগত রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ করতে গিয়ে যেসবের প্রকাশ ঘটছে। সেসবের উপর এখানে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থানটি কী এবং তার উচ্ছেদে কর্মসূচি কী হওয়া উচিত?
এক, নিঃসন্দেহে এর মৌলিক একটি রাজনৈতিক অবস্থান হলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্র।
কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে ভারতের বিশেষ আধিপত্যবাদী/সম্প্রসারণবাদী ভূমিকার প্রশ্নটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে দেশ-জনগণের শত্রু হিসেবে মানলেও কেউ কেউ মনে করেন ভারতও সাম্রাজ্যবাদী দেশ। যার বিপরীতে অধিকাংশ দল সেটা মনে করেন না। যেমন, আমাদের অবস্থান হলো ভারত নিজেই সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত একটি দেশ, যাকে সম্প্রসারণবাদ/আধিপত্যবাদ বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদ নয়।
বাস্তবে এর ন্যায্য সমাধান হতে পারে এ প্রশ্নে গ্রহণযোগ্য কোনো শব্দ-চয়নের মাধ্যমে। তা না করে ভারতের নামে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ ঢুকিয়ে দেয়া ঐক্যকে বিনষ্ট করার সামিল, যা কেউ কেউ করতে চান।
– সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকেও নির্দিষ্ট না করার ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা রয়েছে। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হলো মার্কিন, রুশ ও চীন। এই তিন সাম্রাজ্যবাদকে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করলে বিপদ হলো এই যে, এখনো কেউ কেউ চীনকে সমাজতান্ত্রিক/জনগণতান্ত্রিক দেশ মনে করে। এই মনে করার রাজনৈতিক অবস্থান বর্তমান বিশ্বের কোনো বাস্তব চিত্র আনতে সক্ষম নয়। এবং তারা প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিও হতে পারে না। জনগণকে তারা সঠিক পথও দেখাতে পারে না।
দুই, ফ্যাসিবাদ অবসানে কী ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে?
কেউ কেউ বলছেন, এটা হবে “অস্থায়ী সরকার”। কেউবা আরো বেড়ে বলতে চান “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার”।
“অস্থায়ী” বা “অন্তর্বর্তীকালীন”– যা-ই বলা হোক না কেন, এর শ্রেণি-চরিত্রটি প্রকাশ হয় না। এগুলো বাস্তবে বিরোধী বুর্জোয়া দলগুলোর ভাষা। একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার অপসারিত হলে ও “নির্বাচিত” সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো চরিত্রের সরকারই “অস্থায়ী” বা “অন্তর্বর্তীকালীন”।
এর মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া বিরোধীরা বিদ্যমান ব্যবস্থা, ফ্যাসিবাদী শক্তি ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে অবিকৃত রেখে সরকার/মুখ বদল করতে চায়। এটা বুর্জোয়া সংস্কারবাদী কর্মসূচির পথ করে দেয়।
ফ্যাসিবিরোধী বা অস্থায়ী, গণসরকার বা বিপ্লবী সরকার না হলে ফ্যাসিবাদকে অনুমোদন দেয়া সংবিধান বিলোপ করা, আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপ্লবী রূপান্তরের পথে আগানো, ফ্যাসিবাদীদের দমন করা ও তাদের অপকর্মের বিচার করা সম্ভব নয়। আর সেগুলো না করলে জনগণের জন্য একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাও গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বিপুল ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করে গণশত্রু শাসকশ্রেণির থেকেই কাউকে বেছে নেবার নির্বাচনে জনগণের কোনো স্বার্থই থাকতে পারে না।
তিন, কীভাবে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটতে পারে?
বুর্জোয়ারা ‘অহিংস’, ‘শান্তিপূর্ণ’ গণআন্দোলন বা এমনকি গণঅভ্যুত্থানের কথাও বলে থাকে। সেভাবে এখানেও অনেকে বুর্জোয়াদেরই প্রতিধ্বনি করতে চান।
অহিংস ও শান্তিপূর্ণ শব্দগুলো বুর্জোয়া শ্রেণি চালু করেছে জনগণের আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য। তারা এটা করে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে অভয়বাণী দেবার জন্য, এবং নিজেদের দিক থেকে তাদেরকে আশ্বাস দেয়ার জন্য যে, আমরা যতই গণআন্দোলন করি না কেন, সেগুলো ব্যবস্থাকে ভাঙবে না। ব্রিটিশ আমলে গান্ধী ছিল এ ধারার উদ্গাতা; যা পরে শেখ মুজিব চালু করেছিল জনগণের বিদ্রোহ বিপ্লবকে বিরোধিতা করার জন্য।
একটা কথা অবশ্য চালু আছে– “গণঅভ্যুত্থান”। কিন্তু প্রকৃত গণঅভ্যুত্থান কীভাবে শান্তিপূর্ণ হতে পারে? কেউ কেউ বলেন, গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহ্য রয়েছে বাংলাদেশে। সত্য বটে। কিন্তু এটাও সত্য যে, সেসব ঐতিহ্যের পথ ধরে জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কেন? ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান যাতে গণক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পথে না যেতে পারে সেজন্য শাসকশ্রেণি তাদের মুখ বদল করেছিল, অন্যদিকে বিরোধী বুর্জোয়াদের দ্বারা জনগণকে ব্যবস্থার অধীনে ‘শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনী পথে নিয়ে গিয়েছিল। ফলে জনগণ ক্ষমতা লাভ করতে পারেন নি। ’৭১-এও সেটাই তারা করেছিল। কিন্তু জনগণ পথটিকে শেষ পর্যন্ত বর্জন করেছিলেন। তারা বলপ্রয়োগের পথে গিয়েছিলেন।
তাই, এদেশে শুধু গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহ্য রয়েছে এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। বরং ঐতিহ্য হলো এটাও যে, ব্যাপক রাজনৈতিক গণআন্দোলন সর্বদাই সহিংস হয়ে উঠেছে। যদিও নেতৃত্বের সমস্যার কারণে সেগুলো পরিণতিতে পৌঁছাতে পারেনি। শুধু তাই নয়, জনগণ গণআন্দোলন ছাড়াও আরো বিবিধ ধরনের ও রূপের লড়াই-সংগ্রামের পথ গ্রহণ করেছেন। জনগণের বিদ্রোহ কখনোই অহিংসাকে অতিক্রম না করে থাকে নি। তাই, জনগণের লড়াই-সংগ্রাম কখন কোথায় কী রূপ নেবে বা নেয়া উচিত/সঠিক, তাকে “গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান” বলার মধ্য দিয়ে ছকে আটকে রাখাটা বুর্জোয়া ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্তিতে ভোগা ব্যতীত আর কিছু নয়। আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বন্ধুদের অনেকেই এ বিভ্রান্তিতেও রয়েছেন।
** উপরোক্ত বিষয়গুলোতে, এবং আরো অনেক গৌণ প্রশ্নে মতপার্থক্য রয়েছে যার নিরসনের চেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো কোনো বন্ধুর মাঝে ঐক্য প্রশ্নে নীতি-নৈতিকতারও ঘাটতি দেখা যায়।
বিভিন্ন মতপার্থক্য সত্ত্বেও যখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে একমনা সংগঠন একত্রে কোনো জোট বা কাজ করতে চায় তখন নিম্নতম নীতি হলো অন্যের মতপার্থক্য রক্ষার অধিকারকে সম্মান জানানো। এবং ঐকমত্যগুলোকে খুঁজে বের করে তার ভিত্তিতে কাজ করা।
কিন্তু দেখা যায় যে, কিছু ব্যক্তি/গোষ্ঠী রয়েছেন যারা অন্যের দ্বিমত জানা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের মত/অবস্থানকে যৌথ মতের উপর চাপিয়ে দিতে চান। শুধু তাই নয়, যৌথ মত গঠিত হবার পরও কেউ কেউ অনৈতিক ভাবে নিজেদের অবস্থানকে ফাঁক-ফোকর দিয়ে কোথাও ঢুকিয়ে দেন, যেন এটা কেউ ধরতে পারবে না।
এগুলো শুধু ক্ষুদে দলবাজী সংকীর্ণতাই নয়, ঐক্যবদ্ধ কাজের প্রশ্নে এগুলো হলো নিম্নতম নৈতিকতার লঙ্ঘন। সুতরাং ঐক্যবদ্ধ কাজের ক্ষেত্রে এসব থেকে অবশ্যই মুক্ত হয়েই কাজ করতে হবে।
* রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রশ্নে বিবিধ দ্বিমত সত্ত্বেও যে কিছু কিছু যৌথ কাজ করা যায় সেটা বিগত কিছু সময় ধরে কয়েকটি বামপন্থি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দল (৯-দল) দেখিয়েছে। সেটা হতে পারে ফ্যাসিবাদ বিরোধী নিম্নতম রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দাবি ও শ্রমিক-কৃষক-জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবিনামার ইস্যু-ভিত্তিক জোট। তাকে অব্যাহত রেখেও অমীমাংসিত রাজনৈতিক কর্মসূচির আলোচনা-বিতর্ক অব্যাহত রেখে আগানো সম্ভব। উচ্চতর ঐক্য না হলে নিম্নতরটিকে ধ্বংস করে ফেলা কোনো বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নয়।
* আজকের বিশ্ব ও দেশীয় পরিস্থিতি যেভাবে গুরুতর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে সেখানে ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামকে গণস্বার্থের ভিত্তিতে এগিয়ে নেয়াটা খুবই জরুরি। সত্য যে, আজকে আমাদের প্রকৃত প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির সামর্থ্য দুর্বল। কিন্তু পরিস্থিতি দাবি করছে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের। সেটা করা গেলে শাসকশ্রেণির সংকটকে কাজে লাগানো সম্ভব জনগণের বিপ্লবের পক্ষে। যেকোনো সচেতন ও সংগ্রামী, সৎ বিচক্ষণ ও নমনীয় রাজনৈতিক শক্তিকে সেটাই করতে হবে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যের সমস্যা
দেশে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে কি না, বা আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী শক্তি কি না তা নিয়ে সাম্রাজ্যাবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে সন্দেহ নেই। কোনো কোনো বামপন্থি একে “ফ্যাসিবাদ” না বলে “স্বৈরতন্ত্র” বলাকে তাত্ত্বিক ভাবে সঠিক মনে করেন। তবে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্র– যা-ই বলা হোক না কেন, গুটিকয় আওয়ামী-দালাল ব্যতীত সবাই মনে করেন যে, এই সরকার গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে বা তারা একটি গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি। সুতরাং গণতন্ত্রের জন্য ফ্যাসিবিরোধী/স্বৈরতন্ত্রবিরোধী সংগ্রাম প্রয়োজন এবং তাতে এ ধরনের শক্তিগুলোর মাঝে ঐক্যও প্রয়োজন।
কিন্তু গণতন্ত্র কাকে বলবো? অথবা শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মধ্যবিত্তের জন্য কী ধরনের গণতন্ত্র প্রয়োজন? এমনকি বিএনপি’র মতো শাসকশ্রেণির দলও গণতন্ত্র’র কথা বলে এবং একারণে তারা এখন সরকার/আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদীও বলে থাকে। আজকে বুর্জোয়া রাজনীতির বিরাট সার্কেলই আওয়ামী শাসনকে গণতন্ত্রবিরোধী শাসন বলছে এবং ’৯০-পরবর্তী ১৫ বছরের শাসনকে গণতন্ত্র বলে পেশ করছে, তার হাজারো ‘ত্রুটি’ ও ‘দুর্বলতা’ সত্ত্বেও। তাই, তাদের ‘গণতন্ত্র’টি অস্পষ্ট নয়। তাহলো, বিদ্যমান ব্যবস্থা/রাষ্ট্রকে অক্ষত রেখে তার অধীনে একটি নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। বিএনপি বা এ ধরনের বুর্জোয়া বিরোধীরা সেটাই চাইছে।
এদের কেউ কেউ অবশ্য ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ বা এ জাতীয় কথাও বলছে- যেমন ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। কিন্তু সে সংস্কারের বিষয়টি মূলত নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। বড়জোর দুর্নীতি-বিরোধী কিছু বিচার-আচার, বা সংবিধানের কিছু সংস্কারের কর্মসূচিকে তারা তুলে ধরে– যদিও তাদের এগুলো খুব একটা স্পষ্ট নয়, বা নির্দিষ্ট নয়। এবং এ প্রশ্নে তাদের মাঝে খুব একটা ঐক্যও নেই।
প্রশ্ন হলো, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিগুলো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে কী কর্মসূচি তুলে ধরবে? উপরোক্ত বুর্জোয়া কর্মসূচি ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তার পার্থক্য কোথায়? তারা কি চলমান ব্যবস্থাধীন একটি নিরপেক্ষ অবাধ ভোটের জন্য লড়াই করবে বা করছে?
এর স্পষ্ট উত্তর হলো, না। শ্রমিক কৃষক নিপীড়িত জনগণ ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই করবে তাদের নিজস্ব কর্মসূচিকে সামনে রেখে ও তার ভিত্তিতে; বুর্জোয়া কর্মসূচির জন্য নয়। বুর্জোয়া বিরোধীরা আজকের ফ্যাসিবাদী পরিস্থিতিতে নিপীড়নের চাপে কিছু কিছু গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি তুলে ধরছে বটে। কিন্তু তাদের কেন্দ্রীয় বিষয়টি হলো নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। তারা জনগণের জন্য কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে না এবং সেরকম কোনো কর্মসূচিও তাদের নেই।
এটা ঠিক যে, গোটা শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ধ্বংস করে জনগণের বিপ্লবী শাসন কায়েম করার রণনৈতিক কর্মসূচির সাথে ফ্যাসিবিরোধী কর্মসূচির পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু খোদ ফ্যাসিবিরোধী লড়াইকেও আমাদের পরিচালিত করতে হবে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার একটি ধাপ হিসেবে। এবং সেজন্য একটি বিপ্লবী কর্মসূচি থাকতে হবে। যদিও সেটা রণনৈতিক সমগ্র কর্মসূচি হবে না, কিন্তু তাকে সেটা সহায়তা করতে হবে, তার অংশ হতে হবে।
নতুবা ফ্যাসিবিরোধী লড়াই পর্যবসিত হবে শাসকশ্রেণির মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইয়ের অংশে। যেটা হয়েছিল ’৯০-সালের এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে। যেখানে হাসিনা-খালেদার আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া নেতৃত্ব আন্দোলনটিকে ব্যক্তি-এরশাদ সরানোর কর্মসূচিতে নামিয়ে দিয়েছিল; ব্যবস্থা, শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে রক্ষা করেছিল এবং সামরিক শাসনকে সরিয়ে ব্যবস্থার অধীনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কিছু সংস্কারকে মেনে নিয়েছিল। আর তাতে হাত মিলিয়েছিল বহু বামপন্থি নামের অধঃপতিত দালালরা। জনগণের মৌলিক কোনো অর্জনই হয় নি, একদিনের ভোটদানের অধিকার ছাড়া, তাও আবার গণশত্রু শাসকশ্রেণির মধ্য থেকেই কাউকে বাছাই করার জন্য। ১৫ বছরের ‘গণতান্ত্রিক’ শাসনে সবাই সেটা দেখেছেন। এমনকি বিদ্যমান ব্যবস্থা (তার বিচার-ব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র ও সংবিধান, এবং সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের সহায়তায়) সে রকম ‘ভোটের অধিকার’-কেও নির্বাসনে পাঠিয়েছে হাসিনা-আওয়ামী নেতৃত্বে, বিগত এক দশক ধরে।
তাই, বিপুল ত্যাগ, শ্রম, জীবন, সম্পদ ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জনগণ সে রকম একটি সমাধান কেন আবার টেনে আনবেন? পার্থক্যটা হলো ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংস্কার, নাকি বিপ্লবী উত্থান? বুর্জোয়াদের থেকে জনগণের বা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তির এটাই হলো পার্থক্য– ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে। এটা ভুলে গেলে বারবার একই বৃত্তে ঘুরতে হবে। তাই জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে ফ্যাসিবিরোধী সেরকম একটি কর্মসূচিকেই সামনে আনতে হবে। যাকে তাত্ত্বিক ভাষায় কৌশলগত কর্মসূচি বলা যেতে পারে।
* আজকের পরিস্থিতিতে সেরকম সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি দেশে খুব একটা শক্তিমান নয়। তারা বহু কেন্দ্রে বিভক্ত। কিন্তু তারাই ব্যাপক নিপীড়িত শোষিত জনগণের স্বার্থকে ধারণ করেন। এবং তারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া পতাকার বদলে একটি গণ-পতাকা তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। এটাই আবার তাদের মাঝে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং একটি জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তাকেও জোরালোভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়া সহজ বিষয় নয়। এমনকি তা যদি একটি যুক্তফ্রন্ট জাতীয় বা আরো ঢিলেঢালা ধরনেরও হয়। কারণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের মধ্যে বহু তাত্ত্বিক মত রয়েছে। রয়েছে আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য। রণনীতির ক্ষেত্রে বিপরীতধর্মী মত ও অবস্থান। ফ্যাসিবাদ ও কৌশলগত বিষয়ে বিবিধ ধরনের উপলব্ধি।
এসব কারণে এ শক্তিগুলোর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ ঐক্যের দিকগুলো সত্ত্বেও একটি কার্যকর জোট-গঠনের কাজ বিকশিত হতে পারছে না।
এ ধরনের সংগঠনগুলো শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রবিরোধী, ফ্যাসিবাদ/স্বৈরতন্ত্র বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সমাজতন্ত্রকামী, শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা কায়েমে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং ফ্যাসিবিরোধী একটি জোটবদ্ধ কার্যক্রমে আগ্রহী। এগুলো হলো ঐকমত্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক।
কিন্তু ফ্যাসিবিরোধী যুক্তকার্যক্রমকে উচ্চতর জায়গায় বিকশিত করার ক্ষেত্রে তাদের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ বহু পার্থক্যও রয়েছে। একটি ঐক্যবদ্ধ কৌশলগত রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ করতে গিয়ে যেসবের প্রকাশ ঘটছে। সেসবের উপর এখানে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থানটি কী এবং তার উচ্ছেদে কর্মসূচি কী হওয়া উচিত?
এক, নিঃসন্দেহে এর মৌলিক একটি রাজনৈতিক অবস্থান হলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্র।
কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে ভারতের বিশেষ আধিপত্যবাদী/সম্প্রসারণবাদী ভূমিকার প্রশ্নটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে দেশ-জনগণের শত্রু হিসেবে মানলেও কেউ কেউ মনে করেন ভারতও সাম্রাজ্যবাদী দেশ। যার বিপরীতে অধিকাংশ দল সেটা মনে করেন না। যেমন, আমাদের অবস্থান হলো ভারত নিজেই সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত একটি দেশ, যাকে সম্প্রসারণবাদ/আধিপত্যবাদ বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদ নয়।
বাস্তবে এর ন্যায্য সমাধান হতে পারে এ প্রশ্নে গ্রহণযোগ্য কোনো শব্দ-চয়নের মাধ্যমে। তা না করে ভারতের নামে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ ঢুকিয়ে দেয়া ঐক্যকে বিনষ্ট করার সামিল, যা কেউ কেউ করতে চান।
– সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকেও নির্দিষ্ট না করার ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা রয়েছে। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হলো মার্কিন, রুশ ও চীন। এই তিন সাম্রাজ্যবাদকে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করলে বিপদ হলো এই যে, এখনো কেউ কেউ চীনকে সমাজতান্ত্রিক/জনগণতান্ত্রিক দেশ মনে করে। এই মনে করার রাজনৈতিক অবস্থান বর্তমান বিশ্বের কোনো বাস্তব চিত্র আনতে সক্ষম নয়। এবং তারা প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিও হতে পারে না। জনগণকে তারা সঠিক পথও দেখাতে পারে না।
দুই, ফ্যাসিবাদ অবসানে কী ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে?
কেউ কেউ বলছেন, এটা হবে “অস্থায়ী সরকার”। কেউবা আরো বেড়ে বলতে চান “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার”।
“অস্থায়ী” বা “অন্তর্বর্তীকালীন”– যা-ই বলা হোক না কেন, এর শ্রেণি-চরিত্রটি প্রকাশ হয় না। এগুলো বাস্তবে বিরোধী বুর্জোয়া দলগুলোর ভাষা। একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার অপসারিত হলে ও “নির্বাচিত” সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো চরিত্রের সরকারই “অস্থায়ী” বা “অন্তর্বর্তীকালীন”।
এর মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া বিরোধীরা বিদ্যমান ব্যবস্থা, ফ্যাসিবাদী শক্তি ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে অবিকৃত রেখে সরকার/মুখ বদল করতে চায়। এটা বুর্জোয়া সংস্কারবাদী কর্মসূচির পথ করে দেয়।
ফ্যাসিবিরোধী বা অস্থায়ী, গণসরকার বা বিপ্লবী সরকার না হলে ফ্যাসিবাদকে অনুমোদন দেয়া সংবিধান বিলোপ করা, আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপ্লবী রূপান্তরের পথে আগানো, ফ্যাসিবাদীদের দমন করা ও তাদের অপকর্মের বিচার করা সম্ভব নয়। আর সেগুলো না করলে জনগণের জন্য একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাও গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বিপুল ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করে গণশত্রু শাসকশ্রেণির থেকেই কাউকে বেছে নেবার নির্বাচনে জনগণের কোনো স্বার্থই থাকতে পারে না।
তিন, কীভাবে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটতে পারে?
বুর্জোয়ারা ‘অহিংস’, ‘শান্তিপূর্ণ’ গণআন্দোলন বা এমনকি গণঅভ্যুত্থানের কথাও বলে থাকে। সেভাবে এখানেও অনেকে বুর্জোয়াদেরই প্রতিধ্বনি করতে চান।
অহিংস ও শান্তিপূর্ণ শব্দগুলো বুর্জোয়া শ্রেণি চালু করেছে জনগণের আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য। তারা এটা করে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে অভয়বাণী দেবার জন্য, এবং নিজেদের দিক থেকে তাদেরকে আশ্বাস দেয়ার জন্য যে, আমরা যতই গণআন্দোলন করি না কেন, সেগুলো ব্যবস্থাকে ভাঙবে না। ব্রিটিশ আমলে গান্ধী ছিল এ ধারার উদ্গাতা; যা পরে শেখ মুজিব চালু করেছিল জনগণের বিদ্রোহ বিপ্লবকে বিরোধিতা করার জন্য।
একটা কথা অবশ্য চালু আছে– “গণঅভ্যুত্থান”। কিন্তু প্রকৃত গণঅভ্যুত্থান কীভাবে শান্তিপূর্ণ হতে পারে? কেউ কেউ বলেন, গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহ্য রয়েছে বাংলাদেশে। সত্য বটে। কিন্তু এটাও সত্য যে, সেসব ঐতিহ্যের পথ ধরে জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কেন? ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান যাতে গণক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পথে না যেতে পারে সেজন্য শাসকশ্রেণি তাদের মুখ বদল করেছিল, অন্যদিকে বিরোধী বুর্জোয়াদের দ্বারা জনগণকে ব্যবস্থার অধীনে ‘শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনী পথে নিয়ে গিয়েছিল। ফলে জনগণ ক্ষমতা লাভ করতে পারেন নি। ’৭১-এও সেটাই তারা করেছিল। কিন্তু জনগণ পথটিকে শেষ পর্যন্ত বর্জন করেছিলেন। তারা বলপ্রয়োগের পথে গিয়েছিলেন।
তাই, এদেশে শুধু গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহ্য রয়েছে এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। বরং ঐতিহ্য হলো এটাও যে, ব্যাপক রাজনৈতিক গণআন্দোলন সর্বদাই সহিংস হয়ে উঠেছে। যদিও নেতৃত্বের সমস্যার কারণে সেগুলো পরিণতিতে পৌঁছাতে পারেনি। শুধু তাই নয়, জনগণ গণআন্দোলন ছাড়াও আরো বিবিধ ধরনের ও রূপের লড়াই-সংগ্রামের পথ গ্রহণ করেছেন। জনগণের বিদ্রোহ কখনোই অহিংসাকে অতিক্রম না করে থাকে নি। তাই, জনগণের লড়াই-সংগ্রাম কখন কোথায় কী রূপ নেবে বা নেয়া উচিত/সঠিক, তাকে “গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান” বলার মধ্য দিয়ে ছকে আটকে রাখাটা বুর্জোয়া ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্তিতে ভোগা ব্যতীত আর কিছু নয়। আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বন্ধুদের অনেকেই এ বিভ্রান্তিতেও রয়েছেন।
** উপরোক্ত বিষয়গুলোতে, এবং আরো অনেক গৌণ প্রশ্নে মতপার্থক্য রয়েছে যার নিরসনের চেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো কোনো বন্ধুর মাঝে ঐক্য প্রশ্নে নীতি-নৈতিকতারও ঘাটতি দেখা যায়।
বিভিন্ন মতপার্থক্য সত্ত্বেও যখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে একমনা সংগঠন একত্রে কোনো জোট বা কাজ করতে চায় তখন নিম্নতম নীতি হলো অন্যের মতপার্থক্য রক্ষার অধিকারকে সম্মান জানানো। এবং ঐকমত্যগুলোকে খুঁজে বের করে তার ভিত্তিতে কাজ করা।
কিন্তু দেখা যায় যে, কিছু ব্যক্তি/গোষ্ঠী রয়েছেন যারা অন্যের দ্বিমত জানা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের মত/অবস্থানকে যৌথ মতের উপর চাপিয়ে দিতে চান। শুধু তাই নয়, যৌথ মত গঠিত হবার পরও কেউ কেউ অনৈতিক ভাবে নিজেদের অবস্থানকে ফাঁক-ফোকর দিয়ে কোথাও ঢুকিয়ে দেন, যেন এটা কেউ ধরতে পারবে না।
এগুলো শুধু ক্ষুদে দলবাজী সংকীর্ণতাই নয়, ঐক্যবদ্ধ কাজের প্রশ্নে এগুলো হলো নিম্নতম নৈতিকতার লঙ্ঘন। সুতরাং ঐক্যবদ্ধ কাজের ক্ষেত্রে এসব থেকে অবশ্যই মুক্ত হয়েই কাজ করতে হবে।
* রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রশ্নে বিবিধ দ্বিমত সত্ত্বেও যে কিছু কিছু যৌথ কাজ করা যায় সেটা বিগত কিছু সময় ধরে কয়েকটি বামপন্থি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দল (৯-দল) দেখিয়েছে। সেটা হতে পারে ফ্যাসিবাদ বিরোধী নিম্নতম রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দাবি ও শ্রমিক-কৃষক-জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবিনামার ইস্যু-ভিত্তিক জোট। তাকে অব্যাহত রেখেও অমীমাংসিত রাজনৈতিক কর্মসূচির আলোচনা-বিতর্ক অব্যাহত রেখে আগানো সম্ভব। উচ্চতর ঐক্য না হলে নিম্নতরটিকে ধ্বংস করে ফেলা কোনো বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নয়।
* আজকের বিশ্ব ও দেশীয় পরিস্থিতি যেভাবে গুরুতর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে সেখানে ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামকে গণস্বার্থের ভিত্তিতে এগিয়ে নেয়াটা খুবই জরুরি। সত্য যে, আজকে আমাদের প্রকৃত প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির সামর্থ্য দুর্বল। কিন্তু পরিস্থিতি দাবি করছে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের। সেটা করা গেলে শাসকশ্রেণির সংকটকে কাজে লাগানো সম্ভব জনগণের বিপ্লবের পক্ষে। যেকোনো সচেতন ও সংগ্রামী, সৎ বিচক্ষণ ও নমনীয় রাজনৈতিক শক্তিকে সেটাই করতে হবে।
আরও খবর
- শনি
- রোব
- সোম
- মঙ্গল
- বুধ
- বৃহ
- শুক্র