চা-শ্রমিক গণহত্যার ১০০ বছর পূর্তির স্মরণ
এ বছরের ২০ মে ছিল চাঁদপুরে চা-শ্রমিকদের গণহত্যার একশতম বছর। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম আসামে পরে ১৮৪০ সালে সিলেট ও চট্টগ্রামে চা উৎপাদন শুরু করে। এ জন্য কোম্পানি ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে আদিবাসী কৃষি শ্রমিকদের আমদানি করেছিল।
চা শ্রমিক সংগ্রহ পদ্ধতি তখন ‘ফ্রি কন্ট্রাক্টস’ নামে পরিচিত ছিল। এই ব্যবসার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা প্রলোভন, শক্তি প্রয়োগসহ অমানবিক পন্থায় শ্রমিকদের আসামে আসতে প্রলুব্ধ করেছে। ১৮৬৩-৬৭ সালের মধ্যে ৮৪,৯১৫ জন শ্রমিক আসামে আসলেও ১৮৬৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে ৩০,০০০ শ্রমিক মারা যান। আসামের মত সিলেট ও চট্টগ্রামের বাগানেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চা শ্রমিক আমদানি করা হয়।
মিথ্যা প্রলোভন, প্রতারণা, নির্যাতনের জন্য শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিবাদ করেও কোনো ফল পায়নি। শ্রমিকদের চা-শ্রমে বাধ্য করার জন্য বৃটিশরা ১৮৫৭ সালে নানা রকম আইন-কানুন জারি করে। ফলে দাবি-দাওয়া বা প্রতিরোধের জন্য শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে বাগান মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি হ্রাসের উদ্যোগ নিলে বৃটিশ বিরোধী গণআন্দোলন চা শ্রমিকদের মধ্যেও প্রভাব ফেলে। ফলে তারা নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯২১ সালের মে মাসে চা বাগানের দাস ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঐ সময়ে নারী পুরুষ শিশুসহ প্রায় ত্রিশ হাজার শ্রমিক নিজেদের আদি বাসস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য বাগান থেকে শ্রমিকরা বেরিয়ে আসেন। চা-শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তখন বরমচাল, কুলাউড়া, শমসেরনগর, শ্রীমঙ্গল, সাতগাঁও এবং শায়েস্তাগঞ্জ রেল স্টেশনে অজস্র শ্রমিক জমা হন। কিন্তু শ্রমিকদের রেলওয়ের টিকিট না দেওয়ার জন্য প্রশাসন আদেশ জারি করে।
টিকিট না পেয়ে শ্রমিকরা রেললাইন ধরে চাঁদপুর ঘাটের দিকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করে। চারিদিক থেকে চাঁদপুরে এসে শ্রমিকরা জড়ো হন। উদ্দেশ্য ছিল নদী পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে যাবেন। বৃটিশ সরকার আগে থেকেই সেখানে পুলিশ মোতায়েন করেছিল। ১৯২১ সালের ২০ মে গোয়ালন্দগামী স্টিমার ঘাটে এসে পৌঁছতেই শ্রমিকরা স্টিমারে উঠার চেষ্টা করলে পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। গুলিতে শত শত শ্রমিক মারা যান, যাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বাকীরা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পালিয়ে যান। গভীর রাতে রেলস্টেশনে ক্লান্ত-শ্রান্ত-ঘুমন্ত শ্রমিকদের কোম্পানির কর্তৃপক্ষ হুমকি-ধমকি দিয়ে বাগানে ফেরানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হলে গুর্খা সৈন্যরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে অনেকের মৃত্যু হয়। শ্রমিকদের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। এই হত্যাকাণ্ডে কতজন নিহত-আহত হয়েছেন তারও কোনো হিসাব তখন করা হয়নি। সেই দিন থেকে চা শ্রমিকরা ২০ মে ‘চা শ্রমিক দিবস’হিসেবে পালন করে আসছেন। কিন্তু অনেক আন্দোলন করেও এই দিবসের স্বীকৃতি মেলেনি একশ বছরেও।
চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের উপর নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে সাধারণ হরতাল আহ্বান করা হয়। আসাম-বাংলার রেল ও জাহাজ কোম্পানির কর্মচারীরা হরতালসহ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। তাদের ধর্মঘট ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাসহ অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ৪,৫০০ রেল শ্রমিক-কর্মচারী চাকুরিচ্যুত হন। শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া (মুসলিম লীগ, কংগ্রেস) নেতৃত্বে চলমান আন্দোলন আপসের মাধ্যমে চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের সমাপ্তি হয়।
বাংলাদেশে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সিলেট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁ, লালমনিরহাটে ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে এবং চা-শ্রমিকের সংখ্যা স্থায়ী এবং অস্থায়ী মিলে প্রায় তিন লক্ষ। বিশ্বের চা উৎপাদনের ৩% বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। বাংলাদেশ আমলে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের জীবনমান বৃটিশ আমলের মতই রয়ে গেছে।
আজকের চা-বাগান মালিক, শাসকশ্রেণি, আওয়ামী সরকার বৃটিশ উপনিবেশিক শাসকদেরই ঔরসজাত সন্তান, চা-শ্রমিকদের দাস ব্যবস্থাও তার জীবন্ত প্রমাণ।
তাই, চা-শ্রমিকদেরকে আশু দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি তাদের মুক্তির জন্য এ দেশের বাঙালি দরিদ্র জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ, দালাল শাসকশ্রেণি, সরকার উচ্ছেদের এবং সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দিতে হবে। কারণ বিপ্লবী সংগ্রামই শ্রমিক-কৃষক সহ সমস্ত নিপীড়িত জনগণের মুক্তির দিশা দিতে পারে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
চা-শ্রমিক গণহত্যার ১০০ বছর পূর্তির স্মরণ
এ বছরের ২০ মে ছিল চাঁদপুরে চা-শ্রমিকদের গণহত্যার একশতম বছর। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম আসামে পরে ১৮৪০ সালে সিলেট ও চট্টগ্রামে চা উৎপাদন শুরু করে। এ জন্য কোম্পানি ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে আদিবাসী কৃষি শ্রমিকদের আমদানি করেছিল।
চা শ্রমিক সংগ্রহ পদ্ধতি তখন ‘ফ্রি কন্ট্রাক্টস’ নামে পরিচিত ছিল। এই ব্যবসার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা প্রলোভন, শক্তি প্রয়োগসহ অমানবিক পন্থায় শ্রমিকদের আসামে আসতে প্রলুব্ধ করেছে। ১৮৬৩-৬৭ সালের মধ্যে ৮৪,৯১৫ জন শ্রমিক আসামে আসলেও ১৮৬৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে ৩০,০০০ শ্রমিক মারা যান। আসামের মত সিলেট ও চট্টগ্রামের বাগানেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চা শ্রমিক আমদানি করা হয়।
মিথ্যা প্রলোভন, প্রতারণা, নির্যাতনের জন্য শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিবাদ করেও কোনো ফল পায়নি। শ্রমিকদের চা-শ্রমে বাধ্য করার জন্য বৃটিশরা ১৮৫৭ সালে নানা রকম আইন-কানুন জারি করে। ফলে দাবি-দাওয়া বা প্রতিরোধের জন্য শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে বাগান মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি হ্রাসের উদ্যোগ নিলে বৃটিশ বিরোধী গণআন্দোলন চা শ্রমিকদের মধ্যেও প্রভাব ফেলে। ফলে তারা নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯২১ সালের মে মাসে চা বাগানের দাস ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঐ সময়ে নারী পুরুষ শিশুসহ প্রায় ত্রিশ হাজার শ্রমিক নিজেদের আদি বাসস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য বাগান থেকে শ্রমিকরা বেরিয়ে আসেন। চা-শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তখন বরমচাল, কুলাউড়া, শমসেরনগর, শ্রীমঙ্গল, সাতগাঁও এবং শায়েস্তাগঞ্জ রেল স্টেশনে অজস্র শ্রমিক জমা হন। কিন্তু শ্রমিকদের রেলওয়ের টিকিট না দেওয়ার জন্য প্রশাসন আদেশ জারি করে।
টিকিট না পেয়ে শ্রমিকরা রেললাইন ধরে চাঁদপুর ঘাটের দিকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করে। চারিদিক থেকে চাঁদপুরে এসে শ্রমিকরা জড়ো হন। উদ্দেশ্য ছিল নদী পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে যাবেন। বৃটিশ সরকার আগে থেকেই সেখানে পুলিশ মোতায়েন করেছিল। ১৯২১ সালের ২০ মে গোয়ালন্দগামী স্টিমার ঘাটে এসে পৌঁছতেই শ্রমিকরা স্টিমারে উঠার চেষ্টা করলে পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। গুলিতে শত শত শ্রমিক মারা যান, যাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বাকীরা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পালিয়ে যান। গভীর রাতে রেলস্টেশনে ক্লান্ত-শ্রান্ত-ঘুমন্ত শ্রমিকদের কোম্পানির কর্তৃপক্ষ হুমকি-ধমকি দিয়ে বাগানে ফেরানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হলে গুর্খা সৈন্যরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে অনেকের মৃত্যু হয়। শ্রমিকদের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। এই হত্যাকাণ্ডে কতজন নিহত-আহত হয়েছেন তারও কোনো হিসাব তখন করা হয়নি। সেই দিন থেকে চা শ্রমিকরা ২০ মে ‘চা শ্রমিক দিবস’হিসেবে পালন করে আসছেন। কিন্তু অনেক আন্দোলন করেও এই দিবসের স্বীকৃতি মেলেনি একশ বছরেও।
চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের উপর নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে সাধারণ হরতাল আহ্বান করা হয়। আসাম-বাংলার রেল ও জাহাজ কোম্পানির কর্মচারীরা হরতালসহ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। তাদের ধর্মঘট ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাসহ অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ৪,৫০০ রেল শ্রমিক-কর্মচারী চাকুরিচ্যুত হন। শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া (মুসলিম লীগ, কংগ্রেস) নেতৃত্বে চলমান আন্দোলন আপসের মাধ্যমে চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের সমাপ্তি হয়।
বাংলাদেশে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সিলেট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁ, লালমনিরহাটে ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে এবং চা-শ্রমিকের সংখ্যা স্থায়ী এবং অস্থায়ী মিলে প্রায় তিন লক্ষ। বিশ্বের চা উৎপাদনের ৩% বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। বাংলাদেশ আমলে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের জীবনমান বৃটিশ আমলের মতই রয়ে গেছে।
আজকের চা-বাগান মালিক, শাসকশ্রেণি, আওয়ামী সরকার বৃটিশ উপনিবেশিক শাসকদেরই ঔরসজাত সন্তান, চা-শ্রমিকদের দাস ব্যবস্থাও তার জীবন্ত প্রমাণ।
তাই, চা-শ্রমিকদেরকে আশু দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি তাদের মুক্তির জন্য এ দেশের বাঙালি দরিদ্র জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ, দালাল শাসকশ্রেণি, সরকার উচ্ছেদের এবং সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দিতে হবে। কারণ বিপ্লবী সংগ্রামই শ্রমিক-কৃষক সহ সমস্ত নিপীড়িত জনগণের মুক্তির দিশা দিতে পারে।
আরও খবর
- শনি
- রোব
- সোম
- মঙ্গল
- বুধ
- বৃহ
- শুক্র